ওবেসিটিতে বাড়ছে মৃত্যুর আশঙ্কা, সাবধান হন আজই

বর্তমানে ভারতে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এই রোগের শিকার এবং সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে ওবেসিটিকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। ওবেসিটির হালহকিকত জানাচ্ছেন ডাঃ পূর্ণব্রত গুণ। 

বর্তমানে ভারতে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এই রোগের শিকার এবং সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে ওবেসিটিকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। ওবেসিটির হালহকিকত জানাচ্ছেন ডাঃ পূর্ণব্রত গুণ। 

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

আজকাল আর বাজার করতে পায়ে হেঁটে বাজার পর্যন্ত যেতে হয় না, এক ক্লিকেই সপ্তাহের বাজার পৌঁছে যাবে আপনার ঘরে, এতে শারীরিক পরিশ্রমও অনেকটা কমে যায় এক ধাক্কায়। বা স্কুল থেকে ফিরে আপনার খুদে পাড়ার মাঠে খেলতে না গিয়ে বসে পড়ল ভিডিও গেম নিয়ে। সে চোখের সামনে থাকায়, আপনারও চিন্তা কমে গেল অনেকটাই। তবে এত কমে যাওয়ার মধ্যেও যা আপনার চোখের আড়ালে বেড়েই চলছে তা হল ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজনের মারণ থাবা।

Advertisment

প্রযুক্তিগত উন্নতির মতো একাধিক কারণে পশ্চিমী সংস্কৃতি ঘেঁষা জীবনযাপনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা বেশিরভাগ। বাড়ছে ফাস্ট ফুডের প্রতি ঝোঁক। এছাড়া নটা-ছটার ডেস্ক জব রয়েছে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। এক জায়গায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে ওবেসিটিতে আক্রান্তের গ্রাফ আজ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। বর্তমানে ভারতে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এই অবস্থার শিকার এবং সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে ওবেসিটিকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আপনি সেই তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই সাবধান হয়ে নিন। ওবেসিটির হালহকিকত জানাচ্ছেন চিকিৎসক পূর্ণব্রত গুণ।

ওবেসিটি কী?

ওবেসিটি হল শরীরের এক বিশেষ অবস্থা। শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলে শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। শরীরের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) দিয়ে ওবেসিটির পরিমাপ করা হয়। সাধারণত, ১৮ থেকে ২২.৫-এর মধ্যে বিএমআই থাকলে তা স্বাভাবিক। বিএমআই হল শরীরের উচ্চতা এবং ওজনের আনুপাতিক হার। কোনও ব্যক্তির বিএমআই-এর মানের স্বাভাবিক সীমা, ২০-২৫ এর মধ্যে। কিন্তু, বিএমআই-এর মান ২৫-৩০ এর মধ্যে হলে বলা হয় সেই ব্যক্তি মোটা, ৩০ এর বেশি হলে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় ক্লাস-১ ওবেসিটি, ৩০-৩৫ হলে ক্লাস-২, ৩৫-৪০ হলে ক্লাস-৩ এবং ৪০ এর বেশি হলে সুপার ওবেসিটি।

Advertisment

ঝুঁকিতে কোন বয়স?

যেকোনও বয়সেই এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। মাঝবয়সীদের মধ্যে এর প্রভাবের সংখ্যা বাড়ছে, বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুরাও শিকার হচ্ছে।  এ ছাড়া পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ঝুঁকি বেশি, ৩৫ বছরের ওপরে হলে। এ ক্ষেত্রে ওবেসিটিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মৃত্যুর হারই বেশি।

মূল কারণ

অত্যধিক মাত্রায় ক্যালোরি যুক্ত খাবার খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবকে ওবেসিটির মূল কারণ হিসাবে ধরা হয়। তা ছাড়া আরও বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন সেডেন্টারি বা শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন, অনিয়মিত খাদ্যাভাস, শরীরচর্চার অভাব, চিপস, পিৎজা, বারগার, কোল্ডড্রিঙ্কস আইসক্রিমের মতো ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুডের প্রতি ঝোঁক, এবং কিছু ক্ষেত্রে হরমোনের সমস্যা হলে মেদ বৃদ্ধি পায়।

কাজের ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন কারণে বেশি মানসিক চাপ, অপর্যাপ্ত ঘুম, ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বেশি বয়সে গর্ভবতী হওয়া - এগুলির কারণেও বিএমআই বেড়ে যায়। সফট এবং হার্ড ড্রিঙ্ক-এর জন্য ওবেসিটি দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও মানুষ ওবেসিটির শিকার হন। এ ছাড়াও রয়েছে ছোটদের পড়াশোনার চাপ, খেলাধূলার জায়গার অভাব, অনলাইন গেমের নেশা, ইনস্ট্যান্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাস।

ওবেসিটি হলে কী কী সমস্যা হতে পারে?

রক্তচাপ বৃদ্ধি, ক্লান্তি, শারীরিক অবসাদ, ঝিমুনি ভাব, হাঁটুর সমস্যা, কোমরে যন্ত্রণা, স্তন ক্যান্সার, স্ট্রোক, কোলন ক্যান্সার, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, উত্তেজনা, স্লিপ অ্যাপনিয়া সহ মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও আছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, বন্ধ্যাত্ব, নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। ওবেসিটির সঙ্গে সুগার, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। একে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ বলা হয়। এর জন্য কয়েক ধরনের ক্যানসারের আশঙ্কাও দেখা যায়। ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রেও আশঙ্কা তুলনামূলক বেশি থাকে।

সুপার ওবেসিটি যুক্ত ব্যক্তিদের আয়ু ১০ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বেরিয়াট্রিক সার্জারি করলে ওবেসিটির পাশাপাশি হাইপার টেনশন, স্লিপ অ্যাপনিয়ার মতো রোগও সারিয়ে তোলা যায়।

নিয়ন্ত্রণ করুন আজই

ওবেসিটি থেকে বাঁচার প্রধান পথ হল জীবনযাপনের পরিবর্তন। খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা, যাকে বলা হয় ডায়েটিং, এবং শারীরিক পরিশ্রম। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, নিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়ার ফলে হয়তো ওজন কমল, তবে তা সাময়িক। একে ধরে রাখতে গেলে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও যোগব্যায়াম চালিয়ে যেতে হবে। যদিও এ ক্ষেত্রে সাফল্যের হার খুব কম। সীমিত খাবার খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রম করার পরেও কাজ না হলে ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। ক্লাস-৩ বা সুপার ওবেসিটির ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

চিকিৎসা কী?

চিকিৎসার তিনটে ধাপ রয়েছে, কারণ সকলেই যে তীব্র ওবেসিটির শিকার এমন নয়। কারও ক্ষেত্রে সরাসরি সার্জারির প্রয়োজন হয়। কারও ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ডায়েট নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামেই ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। না খেয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ একদমই সঠিক পদ্ধতি নয়। চিকিৎসার প্রথম ধাপে গুরুত্ব সহকারে ডায়েট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হাই প্রোটিন, কম ক্যালরি, কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে ওষুধ দিয়ে, তৃতীয় ধাপে অস্ত্রপোচার করা হয়।

কোন ধরণের অস্ত্রপোচার প্রয়োজন

অতিরিক্ত ফ্যাট বের করতে লাইপোসাকশন করা হয়। বেরিয়াট্রিক সার্জারিতে পাকস্থলির আয়তন কমিয়ে দেওয়া হয়, ফলে সেই ব্যক্তির কম খাবারেই খিদে মেটে এবং খাবার থেকে ক্যালোরি সঞ্চয়ের পরিমাণও কম হয়। এ ছাড়া গ্যাস্ট্রিক বাইপাস, মিনি গ্যাস্ট্রিক বাইপাস, ডিওডেনাল সুইচের মতো আরও কয়েক ধরনের শল্য চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া খাদ্যনালীর একটা অংশে বাইপাস করা হয়, এই সার্জারির মাধ্যমে ডায়াবেটিস, রক্তচাপ সহ একাধিক রোগের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়। ২-৩ দিনের মধ্যেই রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যেই ব্যক্তি স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যেতে পারেন।

ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে ওবেসিটির সম্পর্ক কী? নাক ডাকা মানেই কি ওবেসিটি?

অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় মোটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেশ কিছু ওষুধ আছে যেগুলি হরমোন গ্রন্থির উপরে প্রভাব ফেলে। অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ ব্যবহারের ফলেও শরীর স্থূল হয়ে গিয়ে শরীরের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ওজন বাড়লে শরীরে বাড়তি অক্সিজেন লাগে। এই বাড়তি অক্সিজেনের জোগান ঘুমের সময় কমে যায়, তাই জোর করে শ্বাস নিতে হয়। তখনই নাকে শব্দ হয়। এতে ফুসফুসে চাপ পড়ে। এই লক্ষ্মণ দেখেও বোঝা যায় শরীরের ওজন বাড়ছে।

সমস্যা শুরু হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্থূলতা মানেই শরীরে একাধিক রোগের বাসা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ওবেসিটি একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে আমাদের সমাজে, অন্তত এমনটাই বলছে গবেষণা। তাই নিজেকে সুস্থ রাখতে নিজেই তৎপর হন।

health