স্ট্রোক হওয়ার সত্যিই কোনও বয়স লাগে না। এমনকি শরীরের মারপ্যাঁচ অবধি প্রয়োজন হয় না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় জেনেটিক্স গত, হাই প্রেসার কিংবা সুগার থেকে কিন্তু এই সমস্যা আসতে পারে এমনকি শরীরের প্রতি তীব্র অনিয়ম কিন্তু এই পর্যায়ে আপনাকে ফেলে দিতে পারে।
স্ট্রোক নিয়ে প্রাণহানির আওতায় যেমন আছেন সাধারণ মানুষ, তেমনই আছেন তারকা মহলের অনেকেই। এবং বিশেষ করে অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লার মৃত্যুই কিন্তু এই বিষয়ে বেশ নাড়াচাড়া দিয়েছে। অল্প-বয়সিদের মধ্যে স্ট্রোকের সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি কিন্তু সবসময় বেশি। এমনকি অভিনেতা রাহুল রায় নিজেও ২০২০ সালে ব্রেন স্ট্রোকের সম্মুখীন হন। সেই কারণেই সিদ্ধার্থ শুক্লার মৃত্যুতে, তিনি বলেন কোনও মানুষেরই নিজের থেকে কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।
চিকিৎসক পি কে হাজরা (সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, এমআরআই, কলকাতা) স্বয়ং জানিয়েছেন, সারা ভারতবর্ষে স্ট্রোক এসোসিয়েশন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৭ কোটি লোক স্ট্রোকের শিকার হন, এবং তার মধ্যে ৬০ লক্ষ লোক মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়েন তথা ৫৯ লক্ষ মানুষ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যান। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আদৌ কেবলমাত্র মানুষের শরীর নয়। তিনি বলেন, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভারত এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে অপর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক এবং স্ট্রোক ব্যবস্থাপনার কারণেই কিন্তু মানুষ এই ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। রোগের লক্ষণ এবং সচেতনতার অভাবে, স্ট্রোকের কারণে মানুষের মৃত্যুহার কিন্তু বেশি। এবং অবশ্যই এটিকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
স্ট্রোকের ধাঁচ সম্পর্কে তিনি বলেন, মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশে রক্ত সরবারহ হতে যখন বাধা পায় ঠিক তখনই এটি মস্তিষ্কের টিস্যু কে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি এবং অক্সিজেন গ্রহণ করতে বাধা দেয়, যার ফলেই মস্তিষ্কের কোষগুলি মারা যায় তখনই সময়ের আপেক্ষিকতায় এটি হতে পারে। সাধারণত দুই ধরনের স্ট্রোক হতে পারে : ১) ধমনীর রক্ত প্রবাহ (ইসকেমিক স্ট্রোক) বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায়, এবং ২) রক্তনালী ফুটো হয়ে (হেমোরেজিক স্ট্রোক)। কিছু ক্ষেত্রে আবার মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের একটি অস্থায়ী ব্যাঘাত ঘটে যা স্থায়ী উপসর্গ সৃষ্টি করে না, সেটি আবার ক্ষণস্থায়ী ইস্কেমিক নামে অভিহিত।
স্ট্রোকের সবচেয়ে সাধারণ ধরন হল ইসকেমিক স্ট্রোক, ঘটার সময় মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলি বন্ধ বা সরু হয়ে যায়, যা রক্ত প্রবাহকে সীমিত করে। জমাট বাঁধা রক্তনালীগুলিতে চর্বি জমার কারণে মানবদেহ এর শিকার হতে পারে। ধমনীতে চর্বি জমা হয় বা রক্তে জমাট বাঁধে এবং সেটি রক্ত প্রবাহের মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের একটি রক্তনালীতে চলে যায়। আবার হেমোরেজিক স্ট্রোক বেশ অন্য কারণে ঘটে, যখন মস্তিষ্কের একটি রক্তনালী ফেটে যায় বা কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে ফুটো হয়ে যায়।এই অবস্থার মধ্যে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, রক্তনালীর দেয়ালে প্রোটিন জমা, এমনকি ইস্কেমিক স্ট্রোক থেকে রক্তপাত, রক্ত পাতলা করার অতিরিক্ত চিকিৎসা এবং রক্তনালীর দেওয়ালে ফুসকুড়ি এগুলি লক্ষণ করা যায়। একটি ক্ষণস্থায়ী ইসকেমিক আক্রমণ ঘটে যখন বর্জিতাংশ বা জমাট স্নায়ুতন্ত্রের অংশে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয় এবং কমপক্ষে পাঁচ মিনিট স্থায়ী হয়।
আরও পড়ুন সারাদিনের সময় অনুযায়ী কোভিড রিপোর্টে থাকতে পারে পার্থক্য, বলছে গবেষণা
স্ট্রোকের লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে সতর্ক থাকা
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয়তা, অত্যাধিক মদ্যপান, ওষুধের ব্যবহার, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, কার্ডিওভাসকুলার রোগ যেমন অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, হৃদযন্ত্রের সমস্যা এবং পারিবারিক পরিসরে যদি স্ট্রোকের লক্ষণ থাকে, তাহলেও কিন্তু একজন ব্যক্তির স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।বয়স, জাতি, লিঙ্গ এবং হরমোনের মতো অন্যান্য কারণও মাঝে মাঝে স্ট্রোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিভ্রান্ত হওয়া বা কথা বলতে অসুবিধা, পক্ষাঘাত বা হাত, পা বা মুখের অসাড়তা, এক বা উভয় চোখে দেখতে সমস্যা, মাথাব্যথা এবং হাঁটতে সমস্যা হওয়া স্ট্রোকের কিছু সাধারণ লক্ষণ।স্ট্রোক কখনও কখনও সাময়িক বা স্থায়ী অক্ষমতার কারণ হতে পারে, যা মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে প্রভাবিত হয় অথবা এর উপর নির্ভর করে।স্ট্রোকের কোনো উপসর্গ ধরা পড়লে, দ্রুত এবং অবিলম্বে চিকিৎসার হস্তক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এবার আসা যাক আলোচনার মুল অংশে। চিকিৎসক- এর উন্নত প্রযুক্তির চিকিৎসা নিয়ে আদৌ কী ধারনা দিয়েছেন?
যখন একজন ব্যক্তিকে স্ট্রোকের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন জরুরী দল প্রথমে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ক্যারোটিড আল্ট্রাসাউন্ড, সেরিব্রাল অ্যাঞ্জিওগ্রাম এবং ইকোকার্ডিওগ্রামইত্যাদি পরীক্ষাগুলি করে স্ট্রোকের ধরন নির্ধারণ করার চেষ্টা করে।ব্যক্তি যে ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে চিকিৎসা করা হয়।মাঝে মাঝে, কিছু লোকের অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন ধরা পড়ে - একটি অনিয়মিত এবং দ্রুত হৃদস্পন্দনের সমস্যা যা হার্টের বাম অ্যাট্রিয়াল অ্যাপেন্ডেজে (এলএএ) রক্ত জমাট বাঁধার দিকে পরিচালিত করে।এই ধরনের ব্যক্তিদের স্ট্রোকের ঝুঁকি চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি।কিছু লোকের জন্মের আগে হার্টের ভালভে গোলমাল থাকে, একটি অংশ খোলা থাকে যাকে 'ফোরামেন ওভেল' বলা হয় এবং যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্মের সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি পরবর্তীতেও খোলাই থেকে যায় এবং তাকে পেটেন্ট ফোরামেন ওভেল (পিএফও) বলা হয়। পিএফও বেশিরভাগ লোকের জন্য কোনো চিকিৎসার সমস্যা সৃষ্টি করে না কিন্তু কিছু লোকের জন্য এটি হৃদপিণ্ডের একপাশ থেকে অন্যপাশে এবং তারপর মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয়, যার ফলে স্ট্রোক হয়।
এই ধরনের রোগীদের জন্য, ন্যূনতম কাটাছেঁড়া পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যাতে হাসপাতালে কম সময় ব্যতীত হয়, সংক্রমণ কম হয় এবং রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।প্রক্রিয়া চলাকালীন, এলএএ এবং পিএফও একটি ক্যাথেটারের সাহায্যে 'অক্লুডার' নামক একটি যন্ত্র দিয়ে বন্ধ করা হয়।এটি রক্তের জমাট বাঁধাকে মস্তিষ্কের দিকে যেতে বাধা দেয় এবং রক্তনালীতে বাধা দেয়।
যত্নের চেয়ে প্রতিরোধই ভাল, কী বলছেন তিনি?
এমনকি যখন আমরা আজ অত্যাধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তির অধিকারী, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সবসময়ই ভাল। ঝুঁকির কারণগুলো জেনে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অবলম্বন করে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যেতে পারে। কিছু স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার সুপারিশ যেমন উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল কমানো, তামাক ব্যবহার ত্যাগ করা, পরিমিত পরিমাণে অ্যালকোহল পান করা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা, একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া এবং সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে।
চারপাশে এই রোগের সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া এবং আধুনিক চিকিৎসার বিকল্প উপলব্ধ করাও অপরিহার্য।হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলিকে তাদের রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিরীক্ষণের জন্য সার্জনদের প্রয়োজন সন্নিবেশযোগ্য কার্ডিয়াক মনিটর, পোর্টেবল ইসিজি এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মতো উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ। দরকারে তাদের স্ট্রোক ডায়াগনস্টিক সুবিধাগুলি উন্নত করা উচিত।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন