আধুনিক জীবনে দশটা-পাঁচটার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হওয়া মা বাবারা যখন কচি কচি মুখ দেখলেই বলেন, “ওদের জীবনটাই বেশ ছিল’, তাঁরা আসলে ভুলে যান, ছোটদেরও মন কেমন হয়, এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হতে পারে মাত্রাতিরিক্ত। আপনি নিশ্চিত তো আপনার খুদের মধ্যে কোনও উদ্বেগ, কোনও ভাবনা নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান কিন্তু অন্য কথা বলছে। শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি দেখা দিতে পারে আট মাস বয়স থেকে। এবং কিছু ক্ষেত্রে অ্যাংজাইটি নাকি ভালোও, তা চারিত্রিক বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে তা ভয়ের কারণ তো বটেই।
তিন বছর সময় পর্যন্ত মা-বাবার কাছছাড়া হওয়ার উদ্বেগ কাজ করে শিশুদের মধ্যে। স্বভাবতই তাঁদের চোখের আড়াল হলেই কেঁদে ওঠে বাচ্চারা। এছাড়া কোনও বিশেষ পোকামাকড় কিংবা জন্তু জানোয়ার থেকে ভয়, অন্ধকার থেকে ভয়, এসব বাচ্চাদের মধ্যে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই ভয় মনের গভীরে ঢুকে গেলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসা সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়। এরকম পরিস্থিতিতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ দরকার।
আরও পড়ুন, দশক বিদায়! বাঙালি জীবনে কী এল, কী হারাল?
সামাজিক উদ্বেগ
এরকম পরিস্থিতিতে সামাজিক মেলামেশায় অস্বস্তিতে পড়ে শিশুরা। মন খুলে কথা বলতে পারে না। আর পাঁচজন তার ব্যাপারে কী ভাবছে, সে ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকে। স্কুলের এক্সকারশন, খেলাধুলোর সময় এদের বন্ধু তৈরি করতে সময় লেগে যায় অনেক। শুরু থেকেই সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত অভিভাবকদের।
যেসব শিশুরা অতিরিক্ত উদ্বেগের শিকার, তাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (মস্তিস্কের যে অংশ যুক্তিবোধ নিয়ন্ত্রণ করে) কাজ করা কমিয়ে অথবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় শিশুর চিন্তাভাবনা। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব দোলাচলের মধ্যে পড়ে এরা।
আরও পড়ুন, নিজের পরিবারেই আপনার সন্তান লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে না তো?
অ্যাংজাইটিতে ভোগা শিশুদের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা যায় প্রায়শই:
চট করে কেঁদে ফেলে এরা
ক্ষণে ক্ষণে মেজাজ হারায়
ঘুমের ব্যাঘাত হয়, হামেশাই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়
রাতে ঘুমের মধ্যে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে
এক জায়গায় বেশ খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না
খাদ্যাভ্যাসে ঘন ঘন বদল আসে, কখনও খিদে থাকে না, কখনও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খায়
চাহিদা না মেটা পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে
সারা শরীর মাঝে মধ্যেই কাঁপতে থাকে
স্কুলের অথবা বাবা-মায়ের দেওয়া সামান্য চাপও এরা সামলাতে পারে না
সারাক্ষণ বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হওয়ার ভয় এদের গ্রাস করে রাখে
বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা থাকে এই সব বাচ্চাদের মধ্যে
ভবিষ্যতে কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা তাদের পরিবারকে ভেঙে দিতে পারে, এই ভয় তাদের মধ্যে ঘুরপাক খায়
নেতিবাচক ভাবনাই এদের মনে বেশি আসে
কেন এত ভয় পাচ্ছে আপনার সন্তান, খবর রাখেন?
অভিভাবকদের জন্য কিছু পরামর্শ:
ওদের আবেগের অনুভূতি তৈরি হতে দিন
প্রথমে আপনার ছেলে বা মেয়ে কী বলতে চাইছে শুনুন। ওদের আবেগ প্রকাশ করার সুযোগ দিন। ধৈর্য ধরে বোঝার চেষ্টা করুন আপনার সন্তানের অনুভূতি। ও যদি কাঁদতে চায়, কাঁদতে দিন। মানা করবেন না। শিশুর মনের ভেতরকার আবেগকে সে নিজে আগে বুঝতে শিখুক।
বর্তমানে বাঁচতে শেখান
ভবিষ্যতে কী হতে পারে এই ভয় দেখাবেন না। আপনার সন্তানকে বর্তমানে বাঁচতে সাহায্য করুন। এই সময়ে যা ঘটছে, তাতে যেন ও নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারে। ওকে বোঝান, ও যেই সময়ে বাঁচছে সেটা সুন্দর।
আরও পড়ুন, স্মার্টফোনে কাটছে শৈশব, নিশ্চিন্ত ‘আধুনিক’ মায়েরা
সন্তানকে সহানুভূতিশীল হতে শেখান
ক্ষমা করতে শেখান। নিজের ভাই বোন কিংবা সমবয়সী আর পাঁচটা বাচ্চার প্রতি ওর ক্ষোভ জন্মালে ওকে বোঝান, একটা কাজের জন্য পুরো মানুষটা খারাপ হয় না। কোনও মানুষের থেকে তার বিশেষ কোনও আচরণকে ও যেন আলাদা করতে পারে। এই স্বভাব ওকে ক্রমশ সহনশীল করে তুলবে।
নিজেরা অযথা উদ্বিগ্ন হবেন না
আপনার সন্তান কিন্তু প্রথমে আপনার এবং স্কুল যাওয়া শুরু করলে শিক্ষকদের দ্বারাই প্রভাবিত হয় সবচেয়ে বেশি। মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে, এমন পরিস্থিতি এলেও আপনারা যথাসম্ভব শান্ত থাকুন। খেয়াল রাখবেন, আপনার সন্তান আপনাদের আচরণকেই ‘স্বাভাবিক’ ভাবে।
কী হলে কী হতে পারে এই ভয় দেখাবেন না
পরীক্ষার ফল খারাপ হলে বাড়িতে রাগারাগি হতে পারে, বন্ধুরা হাসাহাসি করবে, এমন ভয় আপনার বাচ্চার ভেতর ঢোকাবেন না। বরং ইতিবাচক ভাবে বোঝান, মন দিয়ে পড়াশোনা করলে ফল ভালো হতে পারে, ফল ভালো হলে সবার ভালো লাগবে। জলে নামলে ডুবে যাবে, কুকুরের সামনে গেলে কামড়ে দিতে পারে, এসব ভয় কখনোই দেখাবেন না। নেতিবাচক ফল হতে পারে এই ভয় আগেই ঢুকে গেলে আপনার সন্তান ভীতু হয়ে যাবে। সারা জীবন কোনও চ্যালেঞ্জই নিতে পারবে না।
নিজেকে ভালোবাসতে শেখান
আপনার শিশু যেন অবহেলিত বোধ না করে। ওকে বোঝান ও আপানদের কাছে কতটা বিশেষ। নিজেকে ভালোবাসতে শিখুক। নিজে কোন কাজটা ভালো পারে সে সম্পর্কে অবগত করুন ওকে।