Advertisment

সবচেয়ে কম বিবাহ বিচ্ছেদের দেশ, কিন্তু আড়ালের গল্পটা স্বস্তি দেবে তো?

"এই ব্যবস্থা বা প্রবণতা পাল্টাতে হলে প্রথমেই মহিলাদের শিক্ষা এবং আর্থিক স্বনির্ভরতার দিকে জোর দেওয়া উচিত। মেয়েদের আত্মসম্মান এবং নিজেদের অধিকার নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
indian marriage

সম্প্রতি এক সমীক্ষা নিয়ে সাড়া পড়েছে দেশ জুড়ে। সমীক্ষার ফলাফল জানিয়েছে, ভারতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার নামমাত্র। কিন্তু বিষয়টি চর্চিত হচ্ছে অন্য কারণে। মাত্র ১ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদের হার মানে সবার ঘরেই যে টইটুম্বুর দাম্পত্যসুখ, তেমন কিন্তু নয়। বরং উলটোটাই। সমীক্ষার ফলাফলের পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা সুখের নয় আদৌ। এই সমাজে অধিকাংশ ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্ককেও চিরকাল 'বিয়ে' নামের ছাতার তলাতেই থেকে যেতে হয়। জল-হাওয়া না পাওয়া দাম্পত্যগুলোকেও শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে হয় ওই ছাতার তলাতেই।

Advertisment

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এদেশে হাজারে মাত্র ১৩টি বিয়ের পরিণতি হয় বিচ্ছেদ। সেই হিসেবে বিচ্ছেদের হার ১ শতাংশ, পৃথিবীতে সবচেয়ে কম। বিবিসি-র এই রিপোর্ট এই প্রসঙ্গে দুটি তথ্য দিচ্ছে। প্রথমত,  দেশে সেপারেশনের সংখ্যা বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের তুলনায় তিন গুণ। অর্থাৎ দম্পতি একসঙ্গে থাকতে না পারলেও 'বিবাহ বিচ্ছিন্ন' তকমা পেতে চাইছেন না। দ্বিতীয়ত, ভারতে পুরুষের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছিন্ন মহিলার সংখ্যা বেশি। এ থেকে স্পষ্ট, একবার বিচ্ছেদ হলে মহিলাদের আবার বিয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে যে সমস্যা হয় না বললেই চলে।

আরও পড়ুন, অপরিণত বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার তালিকায় শীর্ষে বাংলা

গৃহ হিংসার শিকার হয়েও, বারবার বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েও মেয়েরা মুখ খুলতেই পারেন না, সমাজ তাঁদের মেনে নেবে না, এই আশঙ্কা থেকে। স্বামী অথবা স্বামীর পরিবারের বিরুদ্ধে তাঁর যা অভিযোগ, সমাজের চোখে তা যথেষ্ট 'অপরাধ' হিসেবে গণ্য হবে না, এই ভয়টা কাজ করতেই থাকে মন থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়েও বলতে না পারা ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে।

এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে মনোবিদ মোহিত রণদীপ জানালেন, "বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া না হলে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে একটা সামাজিক ট্যাবু আছে। দুই পরিবারের সদস্যরাই, বিশেষ করে মহিলার পরিবার, বিচ্ছেদ চান না অধিকাংশ সময়ে। এর পেছনে বিচ্ছেদকামী মহিলার আর্থিক স্বনির্ভরতা একটা বড় ভূমিকা নেয়। আর্থিক স্বাধীনতা না থাকলে  এবং মহিলার নিজের কোনো ভাই বা দাদা থাকলে সম্পত্তির ভাগ হবে, এই আশঙ্কা থেকেই মহিলার পরিবার বিচ্ছেদ চান না অনেক ক্ষেত্রে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। 'বিয়ে' নামক প্রতিষ্ঠানকে আমাদের দেশে 'জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন' হিসেবে দেখার এবং দেখানোর প্রবণতা রয়েছে।"

আরও পড়ুন, মাতৃত্ব, অবসাদ ও অপরাধবোধে

"এই ব্যবস্থা বা প্রবণতা পাল্টাতে হলে প্রথমেই মহিলাদের শিক্ষা এবং আর্থিক স্বনির্ভরতার দিকে জোর দেওয়া উচিত। মেয়েদের আত্মসম্মান এবং নিজেদের অধিকার নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে," বললেন রণদীপ।

আবার শুধু এই কয়েকটা কারণ ছাড়াও আলাদা থাকলেও বিবাহ বিচ্ছেদ চান না ভারতীয়রা। যৌবন ছেড়ে প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছেন এমন জনসংখ্যার দম্পতিদের মধ্যে যে প্রবণতা দেখা যায় সেটি হল, 'এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে দিলাম, এখন বিচ্ছেদের মানে কী?' অর্থাৎ বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়ারও একটা বয়স ঠিক করে দেয় সমাজ - বয়স বাড়লে প্রেমে পাক ধরবেই, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ঘরোয়া আড্ডাতেও শুনবেন 'বিয়ে করব না' বলা তরুণ তরুণীদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে যাতে একা থাকতে না হয় সারাটা জীবন, তাই একজন সঙ্গী দরকার, এবং বিয়ে করেই কাউকে 'সারাজীবনের সঙ্গী' বানাতে হবে।

এরপর থেকে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্ন। বিবাহিত তকমা থাকলে রাত ১১টায় 'অক্ষত শরীরে' ঘরে ফেরার সম্ভাবনা বেশি (পরিসংখ্যান থেকে তা স্পষ্ট। এ দেশে বিবাহিত মহিলাদের ধর্ষণের হার কম)। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাড়ার মা-মাসি-কাকা-জ্যাঠা থেকে রাস্তাঘাট কর্মক্ষেত্রে  মহিলার চরিত্র নিয়ে ছানবিন করার হার তুলনামূলক কম।

আরও পড়ুন, এক দিনের এক বিয়ে

সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে আদৌ সন্তুষ্ট নন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা সোনালী দে। তাঁর মতে, "ভারতের মতো সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বৈচিত্রের দেশে শুধু ভৌগোলিক সীমানার বিচারে এমন সমীক্ষা আদপেই সমাজের ছবি তুলে ধরতে পারে না। বিবাহ বিচ্ছেদের হার শহরে যতটা, আধা শহরে, গ্রামাঞ্চলে, প্রত্যন্ত গ্রামে ক্রমশ এই হার কমতে থাকে। আর বিবাহ বিচ্ছেদের দুটো-চারটা-পাঁচটা কারণকে এভাবে এক ছাতার তলায় আনার  চেষ্টা করলে অতিরিক্ত সরলীকরণ করা হবে। প্রতিটা ঘটনা অভিনব হয়। সামাজিক চাপ, পারিবারিক চাপ, বন্ধুবান্ধবের চাপ, এগুলো তো থাকেই। যে দেশে এখনও কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয়, সে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যা যে মহিলাদেরই হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।"

কার্ল ইয়ুং-এর সামাজিক অবচেতন তত্ত্ব (থিওরি অফ সোশ্যাল আনকনশাস)-এর উল্লেখ করে অধ্যাপিকা বললেন, "আসলে মানুষের মনটা সমাজের আয়না। সমাজের এবং মানব মনের দুটো দিক থাকে, চেতন এবং অবচেতন। বিচ্ছেদ নিয়ে আমাদের মনের ভেতর একসঙ্গে দুটোই কাজ করে। চেতন ভয়ের জন্ম দেয়। আর অবচেতন বিশ্বাসের। প্রথমটির ফলে আমরা ভই পাই, বিচ্ছেদ হলে কী হবে, সামাজিক নিরাপত্তা কতটা কমবে, ইত্যাদি। আর অবচেতন আমাদের ভেতরে 'বিয়ে' - এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটা বিশ্বাস তৈরি করে দেয়। যেখান থেকে আমাদের অবচেতনে একটা ভাবনা চলতে থাকে, বিয়ে এমন একটা সম্পর্ক, যা কখনও ভাঙ্গা যায় না। এই দুই-এর টানাপোড়েনে কেউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। কেউ আগে নেন, কেউ পরে। কেউ আবার সারা জীবনেও নিয়ে উঠতে পারেন না।"

Advertisment