Advertisment

কীভাবে আমরা পেলাম আমাদের পতাকা?

আমাদের জাতীয় পতাকা এলো কোথা থেকে? কার মাথায় এলো এই ভাবনা, যে ভারতের একটিই পতাকা থাকা উচিত? শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এই ভাবনার নেপথ্যে কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ শাসকরাই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
indian national flag history

ছবি: প্রদীপ দাস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন ডিজাইনের পতাকা ব্যবহার করতে দেশের বিভিন্ন 'প্রিন্সলি স্টেট' বা দেশজ রাজ্য। তাহলে আমাদের জাতীয় পতাকা এলো কোথা থেকে? কার মাথায় এলো এই ভাবনা, যে ভারতের একটিই পতাকা থাকা উচিত? শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এই ভাবনার নেপথ্যে কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ শাসকরাই। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর যখন সরাসরি ব্রিটিশ রাজের আয়ত্তে আসে ভারত, প্রশাসনের তরফে দাবি ওঠে জাতীয় পতাকার।

Advertisment

প্রথম ফ্ল্যাগের ডিজাইন ছিল ব্রিটেনের অন্যান্য উপনিবেশ, যেমন ক্যানাডা বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতোই। লাল জমিতে উপরে বাঁদিকে ইউনিয়ন জ্যাক, ডানদিকের মধ্যভাগে স্টার অফ ইন্ডিয়া, যার মাথায় শোভা পাচ্ছে ব্রিটিশ রাজমুকুট।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতে ক্রমশ বাড়তে থাকা রাষ্ট্রচেতনার প্রকাশ ঘটছিল মূলত ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাহায্যে। কাজেই বাল গঙ্গাধর তিলক ঝুঁকলেন গণেশের দিকে, অরবিন্দ ঘোষ বা তাঁর বেশ কিছু বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চেয়েছিলেন কালী, এমনকি গোমাতা চিহ্নও ব্যবহার করার কথা বলেন অনেকে। কিন্তু সবকটি প্রতীকই হিন্দুধর্মের, যার ফলে বাদ পড়ে যাচ্ছিল ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা।

indian national flag history ১৯২১ সালে জার্মানিতে উত্তোলিত হয় এই পতাকা। ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর এলো স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নতুন পতাকা, যার উদ্দেশ্য ছিল জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশে ঐক্য স্থাপন করা। স্বদেশী আন্দোলনে ব্যবহৃত এই 'বন্দে মাতরম' পতাকায় দেখা গেল ভারতের নানা ধর্মের প্রতীক চিহ্ন, পশ্চিমী 'হেরাল্ডিক' মতে সাজানো। এই পতাকাও ছিল তেরঙ্গা - ওপরের সবুজ জমিতে আটটি প্রদেশের প্রতীক হিসেবে আটটি সাদা পদ্ম, নিচের লাল জমিতে সূর্য এবং অর্ধচন্দ্র, মাঝের হলুদ জমিতে হিন্দিতে 'বন্দে মাতরম' লেখা। নিতান্ত সাদামাটা এক অনুষ্ঠানে কলকাতায় প্রথম জনসমক্ষে আনা হয় এই পতাকা, এবং তৎকালীন সংবাদ মাধ্যমেরও কোনোরকম উৎসাহ দেখা যায় নি অনুষ্ঠানটি ঘিরে। সমসাময়িক সরকারি অথবা রাজনৈতিক দলিলেও খুব বেশি উল্লেখ নেই এই পতাকার।

প্রায় একই সময় আরেকটি পতাকার প্রস্তাব করেন ভগিনী নিবেদিতা। এই পতাকার মাঝখানে ছিল বজ্র, যার চারপাশে লেখা বন্দে মাতরম। পতাকাটির চারপাশের কিনারা জুড়ে ১০৮ টি প্রদীপ। ১৯০৬ সালের কংগ্রেসের জাতীয় বৈঠকে উন্মোচিতও হয় এই পতাকা। এর পরেও আরও হরেক ডিজাইনের পতাকার প্রস্তাব আসে, কিন্তু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মনে ধরে না একটিও। ১৯০৯ সালে 'এম্পায়ার ডে'র প্রাক্কালে লন্ডনের 'দ্য টাইমস' পত্রিকাকে লেখা এক চিঠিতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন গভর্নর লর্ড অ্যাম্পটহিল বলেন, "সামগ্রিকভাবে ভারতের বা ভারতের কোনও প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোনও পতাকা নেই। যা অত্যন্ত অদ্ভুত, কারণ ভারত না থাকলে সাম্রাজ্যও থাকত না।"

indian national flag history মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাবিত কংগ্রেসের পতাকা

অবশেষে ১৯১৬ সালে ৩০ টি নতুন ডিজাইনের একটি পুস্তিকা বা বুকলেট মাদ্রাজ হাইকোর্টের কিছু উকিলের দেওয়া অর্থসাহায্যে প্রকাশ করলেন পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া। এতে 'পতাকা আন্দোলন' জারি থাকল বটে, কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ হলো না। তবে ১৯২০-র দশকে জমে উঠল জাতীয় পতাকা নিয়ে আলোচনা, এবং ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধী তাঁর 'ইয়ং ইন্ডিয়া' পত্রিকায় লিখলেন জাতীয় পতাকার প্রয়োজনীয়তার কথা। তাঁর প্রস্তাব ছিল, পতাকা যাই হোক, তার মাঝখানে থাকুক চরকার চিহ্ন। চরকার কথা প্রথম তোলেন সম্ভবত লালা হংসরাজ।

সেই মর্মেই পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়াকে পতাকা ডিজাইন করার কথা বলেন গান্ধীজি, যাতে লাল-সবুজ জমির ওপর থাকবে চরকা। লাল হবে হিন্দুদের রঙ, সবুজ মুসলমানদের। গান্ধীজির ইচ্ছে ছিল, ১৯২১ সালের কংগ্রেস অধিবেশনেই উন্মোচিত হবে এই নতুন পতাকা, কিন্তু সময়সীমার মধ্যে সেটি তৈরি করতে পারেন নি ভেঙ্কাইয়া। পরে গান্ধীজি লেখেন, এতে শাপে বর হয়েছিল, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় চিহ্ন স্থান পায় নি পতাকায়। কাজেই ওই পতাকায় সাদা রঙও জুড়ে দেন তিনি। ক্রমে ধর্মীয় চেতনা থেকে সরে সামাজিক চেতনার দিকে আসতে থাকেন তিনি, এবং শেষমেশ জানান, লাল হলো বলিদানের রঙ, সবুজ আশার, এবং সাদা পবিত্রতার।

সারা দেশে অবাধ গ্রহণযোগ্যতা পায় এই পতাকা। কিছু সংখ্যক মুসলমানের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও কংগ্রেস এবং খিলাফত আন্দোলনের মুসলিম নেতারা সাদরে গ্রহণ করেন এই পতাকা। খুব দ্রুত দেশে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার চেতনা, এবং এই পতাকা হয়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। এতটাই যে, যে ব্রিটিশ প্রশাসন একদিন পতাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিল, সেই প্রশাসনই এবার নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই পতাকা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে কংগ্রেসের পতাকা হিসেবেও গৃহীত হয় এটি।

indian national flag history স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা সম্বলিত ডাকটিকিট

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার কিছুদিন আগে তৈরি হয় সংবিধান সভা। ২৩ জুন, ১৯৪৭-এ স্বাধীন ভারতের পতাকা নির্বাচন করতে গঠন করা হয় একটি অস্থায়ী কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ, এবং সদস্য ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, সি রাজাগোপালচারি, কে কে মুন্সী এবং বি আর আম্বেদকর। এই কমিটিই সুপারিশ করে যে কিছু রদবদল করে, সমস্ত নিহিত সাম্প্রদায়িক অর্থ বর্জন করে কংগ্রেসের পতাকাই হোক ভারতের নতুন জাতীয় পতাকা।

সেইমতো চরকার জায়গায় বসল অশোকচক্র, সর্বধর্মের প্রতীক হিসেবে। এই পরিবর্তনে সায় ছিল না গান্ধীজির, যদিও পরে তিনি তা মেনে নেন। ২২ জুলাই, ১৯৪৭, সংবিধান সভায় এই পতাকা পেশ করেন জওহরলাল নেহরু। স্থির হয়, গাঢ় জাফরানি, সাদা, এবং সবুজ রঙের জমির ওপর বসবে নীল অশোকচক্র। ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭ থেকে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ পর্যন্ত 'ডোমিনিয়ন অফ ইন্ডিয়া', এবং পরবর্তীকালের ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হিসেবে সেই থেকেই স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে তেরঙ্গা।

Advertisment