৮ মার্চ, দিনটা নাকি মেয়েদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রসঙ্গ তুললে ঝটিতি উত্তর আসে, "নিপাত যাক নারী দিবস, আসুক শুধু সাম্যের দিন।" আবার কেউ বলেন, "নারী দিবসকে ব্র্যান্ড নেমের মত ব্যবহারটা বন্ধ করা প্রয়োজন।" কেউ বা আউড়ে দেন কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নারী মুক্তির পূর্ণাঙ্গ রূপ ও তার বাস্তবায়নের ইতিহাস। তবে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে এহেন বাকবিতণ্ডায় না জড়িয়ে চলুন, ঘুরে আসা যাক চেতলার 'ক্রাস্ট অ্যান্ড কোর' ক্যাফেতে।
কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের কাছ থেকে একটা অটো, স্টপেজ পীতাম্বর ঘটক লেন, রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে প্রথম বাঁদিক। সামান্য যেতেই চোখে পড়বে সাদা কমলা রঙে লেখা 'ক্রাস্ট অ্যান্ড কোর'। ক্যাফেতে ঢুকতেই স্মিতহাস্যে আপনাকে স্বাগত জানাবেন ক্যাফের মহিলা কর্মীরা। তারপর মেনুকার্ড দেখে অর্ডার দিয়ে দিন তাঁদের হাতে বানানো কেক, বিস্কুট, মাফিন বা কফি। কী ভাবছেন? এ আর এমন কী?
কয়েকদিন আগে অবধি ওই মহিলা কর্মীদের পরিচয় ছিল, ওঁরা 'মনোরোগী'। পরিস্থিতির অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্যহীন। অবাক হচ্ছেন? এরকম একাধিক মহিলা আজও অহরহ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। যতটা সম্ভব তাঁদের জীবনের দিশা খুঁজে দিতেই তৈরি চেতলার 'ক্রাস্ট অ্যান্ড কোর' ক্যাফে। যার বয়স এখন এক।
আর পাঁচটা ঝাঁ-চকচকে ক্যাফের তুলনায় সাধারণ হলেও, এই ক্যাফের আবহ অনন্য। খাবার অর্ডার নেওয়া থেকে পরিবেশন, বিলিং, সমস্তটাই রীতিমতো দক্ষ হাতে সামলাচ্ছেন কয়েকজন মহিলা। কয়েকবছর আগে এঁদেরকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে 'ঈশ্বর সংকল্প' নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের চেষ্টাতেই জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পেরেছেন 'ওঁরা'। সুস্থ হয়ে ওঠার পর, যে যা কাজে সামান্য হলেও আগ্রহী, তাঁদের নিয়ে দিনের পর দিন চলেছে সে কাজের প্রশিক্ষণ। বিকল্প জীবিকার সন্ধান মিলেছে। তারই উদাহরণ 'ক্রাস্ট অ্যান্ড কোর' ক্যাফে।
একরাশ স্বপ্ন দেখছে ওই কয়েক জোড়া চোখ। আর পাঁচটা মেয়ের মত তাঁরাও চান স্বাভাবিক জীবন। তাঁদের হাতের নিপুণ কাজ দেখলে বোঝা দায় তাঁদের মানসিক অবস্থা। মুখে সারাক্ষণই বজায় রয়েছে আলতো হাসি। এখানে কাজ করতে ভালো লাগে? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এল, "কাজে ব্যস্ত থাকলেই ভালো থাকি। নয়তো মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের কথা। কর্ণাটকের গ্রামের মেয়ে আমি, স্বামীর কাছে দিন রাত অত্যাচারের শিকার হতাম। একদিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে অজানা ট্রেনে উঠে পড়ি। দিনের পর দিন ভয়ানক অত্যাচারে ভারসাম্য হারিয়েছিল আমার মানসিক অবস্থা। তবে আজ আমি সুস্থ, রোজগার করছি।"
কথা ফুরোতে না ফুরোতেই প্রাণখোলা হাসি হেসে শো’কেসের ওদিক থেকে অন্য একজন উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, "আমি কেক বানাতে ভালো পারি।" গড়গড়িয়ে বলতে থাকেন তার রেসিপিও। ঈশ্বর সংকল্পে কর্মরত গরিমা চন্ডক ও নয়নিকা দাস বলেন, "কাজের শেষে বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং ও কম্পিউটার শিখতে যান ওঁরা। কাজ করে প্রতি মাসে স্টাইপেন্ড পান। ঈশ্বর সংকল্পের দায়িত্বে ওঁদের আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড তৈরি করা হয়েছে, যার দেখভাল করেন নিজেরাই।" সঙ্গে সঙ্গে কেক বানানোয় পারদর্শী মেয়ে বলে ওঠেন, "আমি নিজের টাকায় মোবাইল কিনেছি।"
ঈশ্বর সংকল্পের সহ সম্পাদিকা রিঙ্কু সোনি ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর লাবণী রায়। ক্যাফের পুরোটাই পরিচালনা করছেন এঁরাই। "গৃহহীন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মেয়েদের সুস্থ করে সমাজের মূল স্রোতের অন্তর্ভুক্ত করা আমাদের উদ্দেশ্য। তবে ক্যাফের আইডিয়া দিয়েছেন ওঁরাই। আমরা বাস্তবায়ন করেছি। সুস্থ হয়ে ওঠার পর ওঁদের কাছে লোকের বাড়িতে কাজ করার বিভিন্ন সুযোগ আসে। তবে এতে রাজি ছিলেন না ওঁরা। আমাদের জানান, এমন কিছু করতে চান, যার মাধ্যমে সরাসরি সমাজের কাছে স্বীকৃতি পাবেন, মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবেন। আমরা দেখি, ওঁরা প্রতিদিন রান্না করতেন নিজেদের জন্য, যেখান থেকে আমরা এই ক্যাফে খোলার সিদ্ধান্তে আসি। যেহেতু ওঁরা সেভাবে কিছু জানতেন না, তাই প্রথমে বেশ কিছু দিন চলে বেকারির প্রশিক্ষণ।"
মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়ে ক্যাফে, কতটা সফল? লাবনী বলেন, "সাফল্যের মাপকাঠিটা অর্থ দিয়ে মাপা নয়, আমরা চেয়েছিলাম ওঁরা নিজের পায়ে দাঁড়ান। সমাজের তাচ্ছিল্য, একঘরে জীবন থেকে উঠে এসে রোজগার করুন। সেটা ওঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ক্যাফের প্রথম ছমাস ওঁদের পাশে থেকে কাজ বলে দিতে হত আমাদের। সবার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না, লজ্জা পেতেন, ভয় পেতেন। সেই জায়গা থেকে অনেক উন্নত আজ ওঁরা।"
আপাতত এমনটাই 'ক্রাস্ট অ্যান্ড কোর' ক্যাফের প্রাথমিক স্তরের ভাবনাচিন্তা। তবে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এই ক্যাফেকে তুলে ধরতে পারেন আপনারাই। তাহলে সমাজের দুর্ব্যবহারে পিছিয়ে পড়া এই মহিলারা হাঁটতে পারবেন আপনাদের সঙ্গে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক কী কী পাবেন এই ক্যাফেতে
মিলছে পাঁচ রকমের ব্রেড, ছয় রকমের কেক, তিন রকমের টি-কেক, নয় রকমের পেস্ট্রি, চার রকমের কুকিস, পাস্তা সহ আরও অনেক কিছু। দার্জিলিং চা থেকে শুরু করে গ্রিন টি, লেমন টি, মশলা চা, লেমন জিঞ্জার টি আর কফির মধ্যে এসপ্রেসো, আমেরিকানো, ম্যাকিয়াটো, ক্যাফে মোকা, সবই মিলবে এখানে। ফ্রেশ লাইম সোডা, লেমন আইস টি, জিঞ্জার এল, ভার্জিন মোহিতোর মতো প্রাণজুড়োনো মকটেলও পাবেন। এ সবই তৈরি করছেন সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা ওই মনোরোগীরা।
এবছরের নারী দিবসের থিম #ব্যালান্সফরবেটার। তাই এদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্যের প্রসঙ্গ তোলার পাশাপাশি পৌঁছে যান চেতলার 'ক্রাস্ট অ্যান্ড কোর' ক্যাফেতে। যত্ন-আত্তিতে খামতি থাকবে না এতটুকু। আজকের দিনে চলুন ভরসা দিই 'ওঁদের'।