কিছু ক্ষতি অপূরণীয়, কিছু যন্ত্রণা একটু বেশি ব্যক্তিগত। ইরফান খানের মৃত্যু সংবাদ আমাদের সবাইকেই কম বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে। মৃত্যু শোক আত্মস্থ করার আগে ঘটনার আকস্মিকতায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি যে যার মতো। ইরফানের দীর্ঘ অসুস্থতার কথা তো অজানা ছিল না, তবু সব্বার মনে হয়েছে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া অন্যায়। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করলেন ইরাফন অভিনিত চলচ্চিত্রের স্ক্রিনশট। বাঙালি ইরফান অনুরাগীরা বেশিরভাগ শেয়ার করলেন ২০০৭ সালের নেমসেক ছবির। খয়েরি রঙের ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে ইরফান তাঁর ছেলেকে বলে দিচ্ছে, কীভাবে মুহূর্ত ধরে রাখতে হয়ে মনে, ক্যামেরায় নয়। বুকে হাত রেখে বলুন, ছবি শেয়ার হয়তো করেননি, আপনার কি এই ইরফান কেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়েনি?
নেমসেকের ইরফান। মানে অশোক গাঙ্গুলি। ঝুম্পা লাহিড়ীর উপন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত পরিচালক মীরা নায়ারের এই ছবি কখনো অশোক গাঙ্গুলির ছেলে গোগোলের গল্প। আবার কখনও গোগলের মা অসীমার। না, নেমসেক কখনোই অশোক গাঙ্গুলির গল্প হয়ে ওঠেনি। অশোক ছিলেন নেপথ্যে। এমন কী মৃত্যুতেও আড়ালে থেকেছে অশোক। দর্শকের কাছে মৃত্যু এসেছে সংবাদ হয়ে। অশোক গাঙ্গুলি নামের একটা চরিত্রই নিশ্চিত করে গিয়েছে এই ছবি হয়ে উঠবে গোগোল এবং অসীমা কেন্দ্রিক।
আট কিমবা নয়ের দশকে বেড়ে ওঠা বাঙালি প্রজন্ম তো ঘরে ঘরে অশোক গাঙ্গুলিকেই পেয়ে এসেছে বাবা হিসেবে। একটা লোক সারা ঘরে টিকটিকি ছানবিন করে যায় প্রতিরাতে। স্ত্রী নিজের সঙ্গে তাঁর ফোনের সেট গুলিয়ে ফেলে বলে সেটের পেছনে নাম লিখে রাখতে চায়। ভিডিও কল এলে মোবাইল সামনে না রেখে কানের কাছে নিয়ে যায়, এমন নেহাতই আটপৌরে স্বভাবের বাবাদের কখনও পর্দায় দেখতে চেয়েছি আমরা? ইরফানকে দেখে মনে হয়েছে, চেয়েছি। ইরফানকেই বাবা ভেবেছি।
সমুদ্রের ধারে গিয়ে অশোক প্রথম বুঝতে পারছে ক্যামেরা ফেলে এসেছে গাড়িতে, ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অবলীলায় বলে ফেলেছে 'কী করি?' নিজের আনস্মার্ট ভাব ঢাকতে চায়নি অশোক গাঙ্গুলি। নেমসেকেই ইরফান মনে করিয়ে দিয়েছিল আমাদের, বাবাদের ভয় আসলে কাপুরুষতা নয়, ঔদাসিন্য আসলে অবহেলা নয়। আমাদের অস্বস্তি হতো না স্কুলজীবনে ছবিটা দেখতে? মনে হতো না আমার ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাবাটাকে সবাই জেনে যাচ্ছে?
আবার এই ছবিটাই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে বাবারা নেপথ্যে থেকে যায় চিরকাল। শরীরি উপস্থিতি থাকুক, বা না থাকুক, আমাদের জীবনে, আমাদের যাপনে ওপরের দুটো বোতাম খোলা খদ্দেরের পাঞ্জাবি পরা, কাঁচা পাকা উস্কো খুস্কো চুলের বাবারা, ভীষণ রকম আপ টু ডেট না হতে পারা স্বভাব লাজুক অথচ আদর্শর সঙ্গে আপোষ না করা বাবারা, আমাদের সঙ্গে চলতে না পেরে খেই হারিয়ে ফেলা বাবারা আসলে হারিয়ে যায় না, থেকে যায় ভীষণ ভাবে।