আমাদের চারপাশে দেখা মানুষের এক একজন একেক রকম। কেউ খুব হাসি খুশি, জীবন যুদ্ধে হেরে টেরে একশা হয়েও কারো ঠোঁটে হাসির রেশ লেগেই রয়েছে। কারোর আবার অন্যরকম। ফিরে ফিরে বারবারই কারোর মনে হয় 'গেল কী বিফলে জীবনটাই'! কেন এমন হয়? এই পৃথিবীতে সবাই কেন সমান সুখী হয়না? কেন অবিকল একই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলেও সবাই একই রকম ভালো থাকতে পারে না? বিজ্ঞান বলছে, এর উত্তর হয়তো রয়েছে জিনের মধ্যেই। না, কোনও ভিনদেশের গবেষণা নয়, বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগেই চলছে এই গবেষণা। সুখের চাবিকাঠি মানবজিনেই নিহত রয়েছে কি না, তা-ই গবেষণার মূল বিষয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স-এর বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মৈনাক সেনগুপ্তের তত্ত্বাবধানে এগোচ্ছে গবেষণার কাজ। সঙ্গে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ডিন তথা প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক মধুসূদন দাস। বেশ খানিকটা এগিয়েছে গবেষণার কাজ। প্রাথমিক ভাবে কে কতটা সুখে আছেন, বোঝার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে, এ শহরের এবং শহরের বাইরেও প্রায় শ পাঁচেক মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছে কিছু প্রশ্ন তালিকা।- আপনি নিজের জীবন নিয়ে খুশি, জীবন আপনার কাছে অধিকাংশ সময় উপহার হিসেবেই এসেছে। নিজেকে নিয়ে আপনার মধ্যে বড় কোনও না পাওয়া নেই। কিমবা, আপনি যা করতে চেয়েছিলেন আর আদতে যা করতে পেরেছেন, তার মধ্যে বড় কোনও ফারাক নেই। এই রকম কিছু ভাবনাই উল্লেখ করা হয়েছে তাতে। এই ভাবনাগুলির সঙ্গে আপনি সহমত কী না, না হলে কতটা বিরোধিতা করছেন, তার ভিত্তিতেই আপনাকে দেওয়া হবে নম্বর। গবেষকরা পরীক্ষা করে নেবেন আপনার জিনগত গঠন।
আরও পড়ুন, “গরাদের ওপারে সোশাল মিডিয়া নেই, তাই বেঁধে বেঁধে আছে ওরা”
তবে সুখ যেহেতু একটি অনুভূতি, তাই পরীক্ষার পাশ ফেলের মতো নম্বরই শেষ কথা বলবে না। অর্থাৎ প্রাপ্ত নম্বর ৩০ এর ওপর হলেই আপনি সুখী, আর ২৯ এ এসে আটকে গেলে সুখী হওয়া আর আপনার ভাগ্যে নেই, তেমনটা নয় কিন্তু। তবে নিঃসন্দেহে যিনি ৪৮ পেলেন, তার তুলনায় ৭১ পাওয়া মানুষটা জীবনে অনেক বেশি সুখী তো বটেই। এই অভিনব গবেষণা প্রথম শুরু করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ডঃ কে নন্দগোপাল। তাঁর গবেষণাকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অন্যান্য অধ্যাপকেরা। রয়েছেন জেনেটিক্সের দুই ছাত্র মৃণ্ময় ধাউরিয়া এবং তুষার পাইন।
অধ্যাপক মৈনাক সেনগুপ্ত জানালেন, "মানুষের ভালো থাকা না থাকার ওপর জিনের কী ভুমিকা, সেটাই আমাদের গবেষণার মূল বিষয়। অনেক মানুষ আছেন, যারা দীর্ঘ দিন ধরে অবসাদে ভুগছেন, অষুধ খেয়ে অথবা কাউন্সেলিং-এ ফল হয়নি তেমন। সে সমস্ত ক্ষেত্রে ওই সব মানুষের শরীরে সুখের জন্য দায়ী জিন সমূহের অভাব থাকলে বাইরে থেকে কৃত্রিম উপায়ে সেই সব জিন থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিন শরীরে প্রবেশ করানো যায় কি না, তাই-ই নিয়েই গবেষণা চলছে।
আরও পড়ুন, সজনে শাক, অপুষ্টি এবং ভারতের সত্তর পেরনো স্বাধীনতা
তাহলে জন্মের সময় যার যা কিছু ঘাটতি রয়ে যাবে, তা বুঝে নিয়ে বাইরে থেকে জিনের ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়া যায় না? প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক সেনগুপ্ত বললেন, "বাইরে থেকে মানব শরীরে জিন ঢুকিয়ে দেওয়ায় নীতিগত সম্মতি এখনও সারা বিশ্বেই পাওয়া যায় না"।
কিন্তু কে বলতে পারে আজ থেকে কয়েক দশক পর হয়ত আর জিডিপি দিয়ে মাপাই হবেনা দেশের উন্নয়ন। আমাদেরই এক প্রতিবেশি দেশে অবশ্য এখনই তেমনটা হয়। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস দিয়ে মেপে নেওয়া হয় দেশের ভালো থাকা-না থাকা। একদিন হয়তো এ দেশেই মানুষের মনের অন্ধকার গর্ত গুলো বুজিয়ে দেওয়া যাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাত ধরে। সে দিন হয়তো দুঃখ থাকবে না, অবসাদ থাকবে না, প্রতি গৃহস্থেই নির্বিঘ্নে বসে আড্ডা জমাবে কাক-চিল। কে বলতে পারে, হয়তো সেদিন কাশ্মীরেও থাকবে না আর গুলির শব্দ।