গড়পড়তা বাঙালির জীবনে গান বলতেই গলায় আসে রবি ঠাকুর। নয়ের দশক পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানের ধরন ছিল আলাদা। ধারা পাল্টাল যার হাত ধরে তাঁর নাম কবীর সুমন। একই অনুষ্ঠানে শ্রোতা কখনও গলা মেলাচ্ছেন পেটকাটি চাঁদিয়ালে, কখনও আবার 'আকাশ আমায় ভরল আলোয়'। রবীন্দ্রগানের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে একই মঞ্চে, একই সন্ধ্যায় গাওয়া এবং শোনা হল সমকালের গান। রাত পেরোলে বৈশাখের ২৫। তার আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হল গানওয়ালার সঙ্গে।
মঞ্চে শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন, এপাশে শ্রোতারা গলা মেলাচ্ছেন, কবীর সুমনের লাইভ অনুষ্ঠানের আগে এমনটা ধারাবাহিক ভাবে হয়নি বললেই চলে। কেন?
সুমন- এর একটা কারণ আছে। আমার গান কম লোকে শোনেন। কিন্তু যারা শোনেন, তাঁরা আমায় বিশ্বাস করেন। আমার ৭২ বছর বয়স। গলা আগের মতো নেই। কিন্তু আমি নিয়মিত রেওয়াজ করি। তানপুরা শুনতে পাচ্ছেন? আমি রেওয়াজ করছিলাম। আমার গানের শো কিন্তু খুব পেশাদারি হয়। মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে এখনও আমার গান শুনতে আসছে। যারা টিকিট কাটে, তাঁরা কেন আসে? তাঁরা বিশ্বাস করে, এই লোকটা আমাদের ঠকাবে না। বাংলা খেয়ালের অনুষ্ঠানেও একই ঘটনা ঘটে। আমি গাইতে গাইতে বলি, "আসুন বন্ধুরা, একটা মধুর সাম্প্রদায়িকতা করি। এই লাইনটা গাইবেন ছেলেরা, এই লাইনটা মেয়েরা"। এটা সম্পূর্ণ একটা বিশ্বাসের জায়গা।
সুমনের গানে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ যতবার এসেছে, সমসাময়িক অন্য শিল্পীদের গানে ততোটা আসেনি। এটা কেন হল?
সুমন- সমসাময়িক কেন, কোনদিনই আসেনি। বাঙালি কোনদিনই তাঁর গানে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ আনেনি। তবে এটা কেন হয়েছে, তা তো আমি বলতে পারিনা। রবীন্দ্রনাথ আমায় ভীষণ রকম প্রভাবিত করেছেন। বাকিদের হয়তো ততোটা নয়।
'প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবিঠাকুর মূর্তি গড়া'...ছবিটা একটুও বদলাল?
সুমন- এটা চিরকালই একই রকম। সবচেয়ে যন্ত্রণার, সবচেয়ে বিস্ময়ের, রবীন্দ্রনাথ বলুন, নজরুল বলুন, আমাদের সংস্কৃতি কেবল নাগরিক মধ্যবিত্তের হাতে রইল। প্রান্তিক মানুষেরা দূরেই থেকে গেল। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করেন, তাঁরা তো আমাদের বাড়ির লোক হয়ে যান। অথচ সেই মানুষগুলো আমাদের সংস্কৃতির শরিক হতে পারলেন না। আমিও তাঁকে আমার সংস্কৃতির শরিক করে তুলতে পারলাম না। আমার যিনি অন্নদাতা, তাঁকে আমি আমার সংস্কৃতিতে জায়গা করে দিতে পারছি না। কী ছাই করছি তাহলে? এত বড় শূন্যতা, অপূর্ণতা নিয়ে একটা জাতি চলছে। এভাবে কোনও কিছু ঠিক থাকতে পারে? পাশ্চাত্যে এটা হয়না। ধরুন বিটলসের গান। সকলেই শুনছে। চাষি শুনছেন, শ্রমিকও। ট্রাক চালকও শুনছেন। আবার সে দেশের রানীও শুনছেন। কত বড় পরিসর তৈরি হচ্ছে। 'হে জুড' গানটা যখন শুনছেন, সবার চোখে জল। হিন্দি গানের ক্ষেত্রে এটা কিছুটা হয়েছিল, এককালে। এখনকার কথা বলছি না।
আমাদের এখানে সেটা হল না কেন?
সুমন- সামাজিক কোনও পরিবর্তন হয়নি বলে। একই জায়গায় পড়ে রয়েছে। আপনি ভেবে দেখুন, আমাদের এখানে অনেকেরই, বাড়িতে যারা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অথচ তাঁকে আমরা সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবিনা, দায়িত্ব নিই না। পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কও হতেও বাধা নেই। ছোট খাট উপহারও দিচ্ছি। অথচ ছুটির দিনে তাঁকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি না, রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানেও না। সেখানে কাকে নেব? স্ত্রীকে নিয়ে যেতে পারি। আমার মতো আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় থাকা কোনও প্রেমিকা থাকলে, তাঁকেও নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু বাড়ির পরিচারিকাকে নিয়ে যেতে পারি না। আমি পাশ্চাত্যে তেরো চোদ্দ বছর কাটিয়েছি। এটা ইংল্যান্ড ছাড়া আর কোথাও নেই। জার্মানিতে না, হাঙ্গেরিতে না, চেকোস্লোভাকিয়াতে না, কোথাও না। সংস্কৃতিতে, মননে, রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা একটা সামাজিক দূরত্ব বাঁচিয়ে রাখলাম। এখনকার ভাষায় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং। বা বলতে পারেন কালচারাল ডিসট্যান্সিং। তাই রবীন্দ্রনাথ সবার হলেন না। এটা এ দেশেই হয়।