সবরীমালা মন্দিরের দরজা ঋতুমতী মহিলাদের জন্য খুলে দেওয়াতেই এমন ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছে কেরালা, এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন ধর্মীয় নেতারা। যে ব্যাখ্যা বিতর্ক বাড়িয়েছে বৈকি কমায়নি। অনেকে আবার প্রকৃতির ক্ষমতার কথা বলেছেন। প্রকৃতির কাছে হার না মেনে উপায় আছে কী! এমন কথাও বলেছেন অনেকে। হ্যাঁ, প্রকৃতির উপর কারও হাত নেই। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে সত্যিই কী কারও হাত থাকে না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেরালবাসী যদি একটু সাবধান হতেন, তবে এত বড় বিপর্যয় হয়তো এড়ানো সম্ভব হত। অর্থাৎ এ যুগের ভয়াবহ বন্যার জন্য দায়ী মানবজাতিই। কেরালার বন্যায় ম্যান মেড তত্ত্বে সিলমোহর দিয়েছেন পরিবেশবিদ মাধব গাডগিল।
এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে ওই পরিবেশবিদ বলেন, "ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে, যার জেরে এমনটা হয়েছে, ঠিকই। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গত কয়েক বছরে রাজ্যে যে হারে নির্মাণকাজ হয়েছে তাতে এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলা করার ক্ষমতার সঙ্গে আপস করা হয়েছে। যার যন্ত্রণা এখন আমরা ভোগ করছি।" ওই পরিবেশবিদের মতে, যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হত, তবে এতটা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হত না রাজ্যকে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে মাধব গাডগিলের নেতৃত্বে পশ্চিম ঘাট পরিবেশবিদ প্যানেল তৈরি করে পরিবেশমন্ত্রক। পরের বছর গাডগিল প্যানেল পশ্চিম ঘাট অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিল। ওই অঞ্চলে কেরালাসহ ছটি রাজ্যকে পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এলাকায় শিল্প ও খনি সংক্রান্ত কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রস্তাব দিয়েছিল ওই কমিটি। উন্নয়নমূলক কোনও কাজের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়মাবলী চালু করা কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ নিয়ম মেনেই নির্মাণকাজ হচ্ছে কিনা তা দেখতে বলা হয়।
এরপর পরিবেশমন্ত্রকের তরফে আরও একটি প্যানেল তৈরি করা হয়। যে প্যানেলের দায়িত্ব দেওয়া হয় মহাকাশ বিজ্ঞানী কে কস্তুরীরঙ্গনকে। গাডগিল কমিটির রিপোর্ট খতিয়ে দেখতেই এই প্যানেল তৈরি করা হয়। ২০১৩ সালে নতুন প্যানেলের রিপোর্টে গাডগিল প্যানেলের সুপারিশকে লঘু করে দেখানো হয়। একইসঙ্গে নতুন প্যানেলের রিপোর্টে বলা হয় যে, পশ্চিম ঘাটের মাত্র এক তৃতীয়াংশ এলাকাই পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল।
আরও পড়ুন, দুর্যোগ কাটছে, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বানভাসি কেরালা
এরপর রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনার পর গত বছর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরিবেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, পশ্চিম ঘাটের ৫৯ হাজার বর্গ কিমি এলাকা পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল। যে এলাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বড় শিল্প, বড় নির্মাণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। কেরালার ৯,৯৯৩.৭ বর্গ কিমি এলাকা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাখা হয়। এর আগে ১৩,১০৮ বর্গ কিমি এলাকা পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল হিসেবে চিহ্নিত করেছিল নতুন প্যানেল। পরে রাজ্য সরকারের আপত্তিতে তা কমানো হয়।
এ প্রসঙ্গে গাডগিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, "যদি আইন মানত সরকার, যদি শাসনব্যবস্থা ভাল হত, তবে এ ধরনের বিপর্যয় অনেকটাই এড়ানো যেত।" তিনি আরও বলেন যে, রাজ্য সরকারগুলি পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন করতে চায় না। ওরা এটাও চায় না যে, স্থানীয় প্রশাসকের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়া হোক। কেরালার বন্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি সে রাজ্যের পাথর খনন কাজের দিকেও আঙুল তুলেছেন। যে হারে সে রাজ্য পাথর খনন করা হয়েছে, তাতে বিপর্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে। একইসঙ্গে সে রাজ্যে অবৈধ নির্মাণও যে আজকের এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য দায়ী সেকথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে যে পদ্ধতিতে কাজ করা হচ্ছে, তাও অনেকটাই বন্যার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।