‘এত্তা জঞ্জাল’ গায়ে নিয়েই দিনযাপন করত সে। বছরের পর বছর ধরে পানের পিক, প্রস্রাব গায়ে মাখা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। এত জীবাণুর সঙ্গে কি একলা লড়াই করতে পারে কেউ? তাই তো চেহারা ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল। কিন্তু তার ভগ্নদশা দেখে করুণা তো দূর কি বাত, উল্টে তাকে ‘শৌচাগার’ বানিয়ে ফেলেছিল এ শহর। অবশেষে তার কষ্ট বুঝলেন এ শহরেরই এক বাসিন্দা। আর সেই বাসিন্দার হাত ধরেই যেন নতুন জীবন পেল বেহালার একরত্তি পাঁচিল।
ঠিকানা, বেহালার বামাচরণ রায় রোড এলাকার উমাপল্লি। যা পচাপুকুর এলাকা নামেই লোকমুখে পরিচিত। সেই এলাকাতেই বহুবছর ধরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি পাঁচিল। পানের পিক আর প্রস্রাবে যার জরাজীর্ণ দশা হয়েছিল। রং-তুলি বুলিয়ে সেই পাঁচিলের ৩৫০ ফুট লম্বা অংশেই এবার তৈরি হল এ শহরের প্রথম 'স্ট্রিট সাইড গ্যালারি।’ যাঁর হাত ধরে এই পাঁচিলের ভোলবদল হল, তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা রঞ্জিত ঘোষ, যিনি সম্পূর্ণ নিজের খরচে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা মূল্যের এই উদ্যোগ নিয়েছেন।
কীভাবে মাথায় এল এমন আইডিয়া? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে রঞ্জিতবাবু বললেন, "জন্ম থেকে পাঁচিলটা দেখে আসছি। ওখানে সকলে প্রস্রাব করতেন, কেউ পানের পিক ফেলতেন। বহুবার প্রতিবাদ করেছি। অনেককে বকাবকিও করেছি এজন্য। কিন্তু কাজে হয় নি। কেউ কথা শোনেননি। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যখন চেষ্টা করছেন কলকাতাকে লন্ডন বানাবেন, শহরের সৌন্দর্যায়ন করবেন, তখন একজন শহরবাসী হিসেবে আমারও দায়িত্ব থাকে এলাকার সৌন্দর্যায়ন করা। সেই ভাবনা থেকেই স্ট্রিট সাইড গ্যালারি বানালাম।"
স্ট্রিট সাইড গ্যালারিতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি।
এই গ্যালারি তৈরি হল কীভাবে? রঞ্জিতবাবু বললেন, "পাঁচিলের ৩৫০ ফুট লম্বা অংশে রং করা হয়েছে। ভাঙা অংশগুলোতে প্লাস্টার করা হয়েছে। ১০টি ব্লক করা হয়েছে। যে ব্লকগুলিতে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি লাগানো হয়েছে। ল্যামিনেট করা ছবি। প্রায় এক বছরের চেষ্টায় এটা করতে পেরেছি। এটাকে আমরা স্ট্রিট সাইড গ্যালারি বলছি। এ ধরনের গ্যালারি এ শহরে কেন, দেশের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। তবে ইউরোপের কোথাও কোথাও এমন নিদর্শন রয়েছে।"
কী কী থাকছে গ্যালারিতে? বেহালার বাসিন্দা জানালেন, "১০টি ব্লকের আলাদা আলদা নামকরণ হয়েছে। একটি ব্লকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সমাজ সংস্কারের কারিগর’। সেখানে থাকছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাদার টেরিজা, হাজি মহম্মদ মহসিন ও ডিরোজিওর ছবি। পরের ব্লকের নাম 'ক্রীড়াজগতের রত্ন'। সেখানে থাকছে গোষ্ঠ পাল, শৈলেন মান্না, মনোহর আইচ, পঙ্কজ রায় ও ধ্যানচাঁদের ছবি। পরের ব্লকের নাম ‘সাহিত্যের দিশারী’, সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাসের ছবি। এরপর থাকছে 'বিজ্ঞানের জ্যোতিষ্ক', সেখানে থাকছে জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও এপিজে আব্দুল কালামের ছবি। পরের ব্লকের নাম রেখেছি চলচ্চিত্রের কোহিনুর, সেখানে থাকছেন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সত্যজিৎ রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, ছবি বিশ্বাসরা।"
বেহালায় স্ট্রিট সাইড গ্যালারি বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন রঞ্জিত ঘোষ
রঞ্জিতবাবু আরও বললেন, "'সঙ্গীতের জাদুকর' নামেও একটি ব্লক থাকছে, সেখানে রাখা থাকছে শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পান্নালাল ভট্টাচার্য ও শচীন দেব বর্মণের ছবি। ওঁদের গানের লাইনও লেখা রয়েছে। পরের ব্লক 'ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার', সেখানে রামকৃষ্ণ পরমহংস, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, রানি রাসমণির ছবি। এরপরের ব্লক 'বিপ্লব তীর্থ', সেখানে থাকছে ঋষি অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাস, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজি, বিনয়-বাদল-দীনেশ ও রাসবিহারী বসুর ছবি। পরের ব্লক 'নাট্যজগতের অগ্রপথিক', সেখানে গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী দাসী, অমৃতলাল বসু, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্রের ছবি। পরের ব্লক 'স্থাপত্যের একযুগ', সেখানে থাকছে রাইটার্স বিল্ডিং, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল, আলিপুর চিড়িয়াখানা, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, জাদুঘরের ছবি।"
স্ট্রিট সাইড গ্যালারিতে মমতার ছবি রাখা নিয়ে বিতর্ক।
এ প্রসঙ্গে রঞ্জিতবাবু আরও জানালেন, "সব ছবির নীচে লেখা থাকছে প্রত্যকের জন্ম-মৃত্যু তারিখ। তাছাড়া প্রথমে থাকছে মহাত্মা গান্ধীর ছবি। প্রত্যেক ব্লকের মাঝে থাকছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি করে ছবি।" এখানেই বিতর্ক বেঁধেছে। তাহলে কি এতেও রাজনীতির রং লাগল? রঞ্জিতবাবুর সাফ জবাব, "নীল-সাদা রং করেছি বর্ডারে। নীল-সাদা তো আকাশেরও রং, তাহলে কি আকাশেরও কোনও দল আছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, ওঁর ছবি রেখেছি। প্রতিটি ছবির নীচে লেখা রয়েছে 'গতিধারার সারথী', 'প্রতিবাদের কন্ঠ', 'মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রী', 'সৌন্দর্যায়নের প্রতিষ্ঠাতা'-র মতো কথা।" উল্লেখ্য, রঞ্জিতবাবু নিজে একজন তৃণমূল কর্মী। তবে এহেন উদ্যোগ তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত বলে দাবি করেছেন তিনি। রবিবার বেহালার ওই ‘স্ট্রিট সাইড গ্যালারি’র উদ্বোধন করেন ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ।
শহরের এক বাসিন্দার এমন সচেতনতার উদ্যোগ নিয়ে কী বলছেন পরিবেশবিদরা? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বললেন, "নিঃসন্দেহে খুব ভাল উদ্যোগ। খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে মানুষের জীবনের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া দরকার।" আরেক পরিবেশকর্মী নব দত্ত বললেন, "ভাল ব্যাপার, এতে যদি মানুষ সচেতন হন তাহলে তো ভালই হবে। এমন নাগরিক উদ্যোগ আরও যাতে বাড়ে, সেদিকে আমাদের সকলকে দেখতে হবে।"