'বৈদিক' বিবাহ পদ্ধতির উত্তরাধিকারী কে? বাকযুদ্ধে দুই মহিলা পুরোহিত গোষ্ঠী

প্রয়াত গৌরী ধর্মপালের বৈদিক বিবাহ ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পদ্ধতি চুরি করা হয়েছে, এই অভিযোগ তুললেন কন্যা রোহিণী। অভিযোগের আঙুল গৌরী দেবীরই দুই ছাত্রীর দিকে।

প্রয়াত গৌরী ধর্মপালের বৈদিক বিবাহ ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পদ্ধতি চুরি করা হয়েছে, এই অভিযোগ তুললেন কন্যা রোহিণী। অভিযোগের আঙুল গৌরী দেবীরই দুই ছাত্রীর দিকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
rohini dharmapal, রোহিণী ধর্মপাল

বিয়ে দিচ্ছেন মহিলা পুরোহিতরা। ছবি সৌজন্যে, রোহিণী ধর্মপাল।

এ শহরে বৈদিক মতে বিয়ের কথা এতদিনে হয়তো অনেকেই শুনেছেন। সরাসরি এ ধরনের বিয়েতে উপস্থিত না থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিও দেখে থাকতে পারেন।

Advertisment

কী এই বিবাহ পদ্ধতি? এ বিয়েতে কন্যাদানের বালাই নেই, কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন করেন মহিলা পুরোহিতরা। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় চাল দিয়ে কনেকে বলতে হয় না, "বাবা-মায়ের সব ঋণ শোধ করলাম।" নতুন বউকে বর বলেন না, "আজ থেকে তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলাম।" বিয়ে মানেই যেখানে সানাইয়ের সুরে গমগম করে চারদিক, সেখানে এই বিয়েতে শোনা যায় রবীন্দ্রসংগীত। বিয়ের মন্ত্রপাঠে সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলা বা ইংরেজি ব্যবহার করা হয়।

বহু বছর ধরেই এ শহরে বৈদিক মতে বিয়ে দিয়েছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে সংস্কৃতের প্রাক্তন অধ্যাপিকা, প্রয়াত গৌরী ধর্মপাল। যাঁর নিজের বিয়েও হয় এই রীতি মেনে। গৌরী দেবীর সেই বিবাহ পদ্ধতির উত্তরাধিকার নিয়ে এবার টানাপোড়েন শুরু হল। গৌরী দেবীর ছাত্রী নন্দিনী ভৌমিক ও রুমা রায়ের বিরুদ্ধে মায়ের বিবাহ পদ্ধতি "চুরি" করার অভিযোগ তুলে সরব হলেন রোহিণী ধর্মপাল।

Advertisment

কেন অভিযোগ? রোহিণী দেবী বলেন, "গত মার্চ মাসে সংবাদ মাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, নন্দিনী ভৌমিকরাই প্রথম এমন বিয়ে দিচ্ছেন। ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়েছে দেখে আমি নন্দিনী দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওঁকে বলি, প্রতিবেদককে যাতে উনি ভুল শুধরে নিতে বলেন। কিন্তু উনি বলেন, কোনও ভুল নেই। এরপর আমি নিজেই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, নন্দিনী দেবী তাঁকে যা বলেছেন তাই-ই তিনি লিখেছেন। এটা নিয়ে আমি ফেসবুক পোস্ট দিই। অনেক কথা হয়। ইদানিং বাধ্য হয়েই ওঁরা মায়ের নাম নেন।"

gouri dharmapal, গৌরী ধর্মপাল গৌরী ধর্মপাল। ছবি সৌজন্যে: রোহিণী ধর্মপাল

এ প্রসঙ্গে গৌরী তনয়া আরও বলেন, "ওঁরা আমার মায়ের ছাত্রী। ওঁদের ছোটবেলা থেকে দেখছি। কিন্তু ওঁরা আমার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পদ্ধতিও চুরি করে নিজেদের বলে চালাচ্ছেন।" তিনি আরও বলেন, "দুর্ভাগ্য যে, ওঁরা মায়ের ছাত্রী। বহুদিন পর মায়ের কাছে এসেছিলেন, তখন মা অসুস্থ। মায়ের পদ্ধতিতে ওঁরা বিয়ে দেবেন বলে প্রস্তাব দেন মাকে। মা চেয়েছিলেন, এই পদ্ধতি প্রসারিত হোক। বলেছিলেন, ওঁরা এই কাজ করলে উনি খুশি হবেন।"

রোহিণী দেবীর কথা অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালে বৈদিক মতেই বিয়ে হয়েছিল তাঁর মায়ের। তারপর থেকে গৌরী দেবী ওই পদ্ধতিতে বহু বিয়ে দিয়েছেন। "মা বুঝতেন, বিয়ের আসরে সংস্কৃত মন্ত্র অনেকেই বোঝেন না। তাই ছন্দবদ্ধ বাংলায় সেই মন্ত্র তিনি অনুবাদ করেন। ১৯৮৫ সালে 'বেদের কবিতা'-য় তা প্রকাশিত হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হয়। পরে মায়ের বিবাহ পদ্ধতির উপর বইও প্রকাশিত হয়।"

আরও পড়ুন: রাজকীয় কায়দায় বিয়ে হল দীপিকা-রনবীরের, ভাইরাল ছবি

rohini dharmapal, রোহিণী ধর্মপাল রোহিণী ধর্মপাল।

রোহিণী দেবীর সব অভিযোগই কার্যত অস্বীকার করেছেন বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নন্দিনী ভৌমিক। তাঁর বক্তব্য, "সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। দিদি আমাদের দীক্ষা দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে এই কাজ শুরু করি। বিয়েতে দিদি এসেছিলেন। ভাবতে পারিনি যে এমন অপবাদ দেওয়া হবে।"

রোহিনী দেবীর অভিযোগ নিয়ে নন্দিনী দেবী আরও বলেন, "আমরা দিদির ছাত্রী। ছাত্রী আর গুরুর সম্পর্ক কী তা রোহিণী জানেন না। উনি আমায় বলেছিলেন একবার, আমরা যা করছি, তার রোজগারের হিসেব দিতে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম শুনে। দিদি আমাদের বলেছিলেন সাম্মানিক নিতে। উনি বলতেন, টাকা না নিলে লোকে মূল্য দেয় না। সেই হিসেবেই আমরা সাম্মানিক নিই, তাও অনেককে দান করি।"

nandini bhowmik, নন্দিনী ভৌমিক বাম দিক থেকে প্রথমে নন্দিনী ভৌমিক। ছবি সৌজন্যে নন্দিনী ভৌমিক।

শুধু বিয়ে নয়, অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন শ্রাদ্ধ বা অন্নপ্রাশনেও বৈদিক রীতি প্রযোজ্য। এখানেও রয়েছে বিরোধের কাহিনী। রোহিণীর কথায়, "মা অসুস্থ অবস্থাতেই মাসে একবার বেদের ক্লাস নিতেন। ক্লাসে কী পড়াবেন তার ফটোকপি ছাত্রীদের দিতেন। সেগুলো রুমা রায় বাড়িতে নিয়ে যেতেন। আমার মা নাকি ওদের বলেছিলেন, তাঁর শ্রাদ্ধ কীভাবে হবে। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পদ্ধতিও মা তৈরি করেছিলেন, যা এখনও অপ্রকাশিত। সেগুলোও ওঁরা নিজেদের নামে চালাচ্ছেন। নন্দিনী দেবীর শাশুড়ির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন উনি।"

নন্দিনী দেবী বলেন, "একেবারে ভুল কথা। আমার শাশুড়ির শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিজের পদ্ধতিতে করেছিলাম। অনেক পরিশ্রম করেছিলাম। রোহিণীর মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না। ওঁদের পারিবারিক সমস্যা ছিল অনেক।"

আরও পড়ুন, এক দিনের এক বিয়ে

nandini bhowmik, নন্দিনী ভৌমিক নন্দিনী দেবীর মেয়ের বিয়েতে গৌরী দেবী। ছবি সৌজন্যে: নন্দিনী ভৌমিক

বেশ কয়েক বছর হল নন্দিনী দেবীরা এ শহরে বিয়ে দিচ্ছেন। এবং রোহিণী এই বিবাহ রীতি শুরু করেছেন এ বছরের ১৮ নভেম্বর থেকে। মায়ের বিবাহ পদ্ধতি এত দেরিতে শুরু করলেন কেন? জবাবে বললেন, "কখনও ভাবি নি একাজ করব। নন্দিনী ভৌমিক, রুমা রায়রা এই নোংরামি না করলে, মিথ্যা না বললে, এটা ভাবতাম না। আমার তো আপত্তি নেই, যে ওঁরা এমন পদ্ধতিতে বিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু নিজেদের নামে চালাচ্ছেন কেন?"

kolkata news