১৮৫৬ সালের ৬ মে, গ্রীষ্মের কলকাতা, সকালে চাঁদি ফাটানো রোদ আর সন্ধ্যায় নেই একফোঁটা হাওয়া। কলকাতার ঘাটে এসে পৌঁছল আওয়াধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্-এর স্টিমার। সঙ্গে প্রায় ৫০০ জন। কোনও ঐতিহাসিকের মতে, তিনি প্রথমে বেলগাছিয়া ও তারপরে মেটিয়াবুরুজে গিয়ে ওঠেন, আবার কারও মতে তিনি প্রথম থেকেই মেটিয়াবুরুজে ছিলেন। নবাব তাঁর সুবিশাল দলের মধ্যে সঙ্গে করে এনেছিলেন তাঁর উৎকৃষ্ট রাধুনিদেরও। এমনই রাঁধুনিদের হাত ধরে আওয়াধের বিরিয়ানিতে পড়ে যায় আলু। এই যুগলবন্দি খাদ্যরসিক নবাবকে খুশি করে দেয়। ব্যাস, সেই তবে থেকে কলকাতায় শুরু হয়ে যায় বিরিয়ানি আর আলুর যুগান্তকারী প্রেম। উত্তম-সুচিত্রার মতো জুটিকেও হার মানিয়ে বিরিয়ানি আর আলুর এই জুটি বাঙালির এমনই প্রিয় হয়েছে যে হাল আমলে বাজারে ছেয়ে গেছে শুধু ‘আলু বিরিয়ানি’। মাংস ছাড়াই ভেতো বাঙালি চেটেপুটে খাচ্ছে এই ডিশ। আসুন না, উনিশ শতকে কলকাতার ঘটকগিরিতে আওয়াধের বিরিয়ানি আর আলুর প্রেম থেকে আজকের আলু বিরিয়ানি অবধি এই সুস্বাদু সম্পর্কটাকে হাল্কা চেখে দেখা যাক।
নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্ খুবই খাদ্যরসিক মানুষ ছিলেন। এই কারণে তিনি রাঁধুনিদের মাঝে মাঝে ছুটিও দিতেন। শুনতে কেমন একটা অদ্ভুত লাগল না? একথা একদমই ঠিক। নবাব এই ছুটি দিতেন নতুন নতুন খাবার আবিস্কার করা অথবা প্রচলিত পদেই নতুন এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। এরপর বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার বেশ কয়েকটা লোককথা প্রচলিত আছে। একটা হল, এই এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে নবাবের রাঁধুনিরা খরচা কমানোর জন্য বিরিয়ানিতে কয়েকপিস মাংসের পরিবর্তে আলু দিয়ে দেন। আরেকটা জনশ্রুতি এমনও আছে যে, ১৮৮৭ সালে নবাবের মৃত্যুর পর রাঁধুনিরা খুবই অর্থসঙ্কটে পড়ে আর সে কারণবশত তারা বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া শুরু করে মাংসের সঙ্গে।
তবে এই জনশ্রুতিগুলোকে না মেনে নবাবের বংশধররা একটু অন্য কথা বলেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নবাব ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বছরে যে বারো লাখ টাকার পেনশন পেতেন তাতে তিনি তাঁর রসনাবিলাস ঠিকই বজায় রাখতে পেরেছিলেন। তাতে যদিও না কুলোয় তাহলে নবাবের সেটুকু সামর্থ্য ছিল যে তিনি তাঁর নিজের বিলাসের দায়িত্ব নিজে নিতে পারেন। তাদের গল্প অনেকটা এমন যে, নবাবের কোনো এক রাঁধুনি একদিন বিরিয়ানির স্বাদ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে চালে আলু দিয়ে রান্না করে আর নবাবকে পরিবেশন করে। নবাবের এই আলু দেওয়া বিরিয়ানি এতই ভালো লাগে যে তিনি বলেন এবার থেকে নিয়মিত বিরিয়ানিতে আলু দিতে হবে। এইভাবে বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া শুরু হয় যা পরবর্তীকালে বাঙালির প্রিয় হয়ে ওঠে। তবে, জনশ্রুতি আর মতামত যাই থাকুক একথা মেনে নিতেই হয় বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার চল শুরু হয় এই কলকাতা থেকেই।
আরও পড়ুন ব্রিটিশ রাজের রোষে নিষিদ্ধ হয়েছিল এই মিষ্টি, ‘জয় হিন্দ’ সন্দেশের গল্প জানলে গর্ব হবে
মনে পড়ে যায় কবি জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত লাইনটা, “হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”। না, কলকাতার পথে বিরিয়ানি আর আলু হাত ধরাধরি করে হাজার বছর ধরে না হলেও কয়েকশো বছর ধরে নিশ্চয়ই পথ হেঁটে চলেছে। কালে কালে তা নবাবের থালা থেকে পথ হেঁটে আজকের ভেতো বাঙালির প্লেটে গিয়ে উঠেছে। এর মাঝে হয়েছে আরও কতরকম এক্সপেরিমেন্ট। এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আজকের বাঙালি হাতে পেয়েছে ‘আলু বিরিয়ানি’কে। যেখানে থাকে না মাংসের ‘ম’ ও। কেবলমাত্র বিরিয়ানির চাল আর আলুর যুগলবন্দি। ঠিকঠাক সময় না জানা গেলেও মোটামুটি শেষ দশ-বারো বছরে কলকাতার অলিতে গলিতে বহুল পরিমাণে যে বিরিয়ানির দোকানগুলো খুলে গেছে সেখানে এই আলু বিরিয়ানির প্রথম দেখা পাওয়া যায়।
মাংসাশী বাঙালির কাছে কীভাবে মাংস ছাড়া এই বিরিয়ানি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল? এই বিষয়ে ফুড হিস্ট্রি ও কুইজিন বিষয়ের গবেষক এবং সুশীল কর কলেজের ইংরাজি বিভাগের অধ্যাপিকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর বক্তব্য হল, “আলু বিরিয়ানির এই জনপ্রিয়তার পিছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমত, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তা খুব সহজে হাতের কাছে পাওয়া যায়। যাদের রান্না করার সময় বা জায়গা কোনোটাই নেই তারা খুব সহজেই পাড়ার দোকান থেকে চট করে কিনে এনে খেতে পারেন। এই কারণে অনেকেই নিয়মিতভাবে এই আলু বিরিয়ানির উপর ভরসা করে দিন কাটান। আর দ্বিতীয়ত হল অর্থনৈতিক দিক। আলু বিরিয়ানি দামে অনেক কম। আমার মনে পড়ে প্রথম প্রথম যখন পাড়ার দোকানে আলু বিরিয়ানি বিক্রি হওয়া শুরু হয়েছিল তখন তার দাম ছিল তিরিশ কী চল্লিশ টাকা। কিন্তু হ্যাঁ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল বিরিয়ানিতে আলুর ফ্লেবারটা। আলু বিরিয়ানিতে মাংস না থাকলেও আপনি মাংসের ফ্লেবারটা মিস করবেন না। কারণ বিরিয়ানির পুরো ফ্লেবারটাই ওই আলুর মধ্যে থাকে। তাই মাংস দেওয়া বিরিয়ানি যারা কিনতে পারেন না অনেকসময়ে তারা এই আলু বিরিয়ানিই বেছে নেন। আবার অনেকক্ষেত্রে কিছু স্বাস্থ্য সচেতনতাও কাজ করে।”
তবে যুক্তি-তর্ক যাই থাকুক একটা কথা ঠিক, কী নবাব আর কী আজকের কলকাতাবাসী, বিরিয়ানি আর আলুর প্রেম যুগে যুগে সবার কাছেই প্রিয়। একসময়ে বিরিয়ানিতে আলুর অন্তর্ভুক্তি থেকে আজকের আলু বিরিয়ানি অবধি এই যুগলের পথচলা সেই জনপ্রিয়তারই প্রমাণ দেয়।
সূত্র:
Kanjilal, Mohona, ‘A Taste of Time: A Food History of Calcutta’
শ্রীপান্থ, ‘গনেশ পাইন চিত্রিত মেটিয়াবুরুজের নবাব’