/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/11/Parash-pathar.jpg)
কার্জন পার্কের এই 'পরশপাথর অঙ্গন'। ছবি- শশী ঘোষ
'ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল'। সুকুমার রায়ের 'হ-য-ব-র-ল' গল্পের সেই ভুতুড়ে কাণ্ড বাস্তবেও ঘটে। যেমন ঘটেছে ধর্মতলার কার্জন পার্কের ভাষা উদ্যানে। দিনে ভবঘুরে নেশারুদের আড্ডাখানা, রাতে সমাজবিরোধীদের আদর্শ আশ্রয়। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে প্রায় একযুগ আগে এই ভাষা উদ্যান তৈরি করা হয়েছিল। বছর চারেক আগেও সাফসুতরো করে ২১ ফেব্রুয়ারিতে নমো নমো করে একটা অনুষ্ঠান করা হত। এখন সে অনুষ্ঠানও অতীত। মদের বোতল, প্লাস্টিকের গ্লাসে এমনভাবে চারপাশ ছেয়ে রয়েছে, যে দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক। ঝোপ জঙ্গল আগাছায় ঢাকা পড়ে গেছে শহীদদের স্মৃতি ফলক। ঝাপসা হতে বসেছে স্মৃতিসৌধের গায়ে 'আ মরি বাংলা ভাষা' লেখাও।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/11/curzon-park-1.jpg)
ভাষা উদ্যানের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে শহরের একটি উল্লেখযোগ্য 'হেরিটেজ' স্থাপত্য, পানিওতি ফাউন্টেন। সাল ১৯৫৮। সত্যজিৎ রায় পরশুরামের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি করছেন 'পরশ পাথর'। পরেশবাবুর চরিত্রে অভিনয় করছেন তুলসী চক্রবর্তী। ছবিটির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, পরেশবাবু বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে ওই সৌধের নীচে আশ্রয় নিচ্ছেন। ১৯৫৮ থেকে ২০১৮, অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। ৬০ বছর আগের ছবিতে দেখানো কার্জন পার্কের সঙ্গে বর্তমান এই জায়গার আকাশ পাতাল পার্থক্য।
জয়পুর মার্বেল দিয়ে ১৮৯৮ সালে এই সৌধটি তৈরি করা হয় তৎকালীন বড়লাটের সচিব দেমেত্রিউস পানিওতির স্মরণে। পানিওতি ছিলেন গ্রিক, কিন্তু চার পুরুষ ধরে তাঁদের পরিবারের অনেকেই ছিলেন কলকাতাবাসী। কলকাতা পুরসভার 'হেরিটেজ সাইট'-এর তালিকায় উল্লেখ রয়েছে সৌধটির। কুড়ি বছর আগে তৎকালীন সরকার সৌধের নাম বদলে করেন 'পরশ পাথর অঙ্গন'। পরশুরাম (রাজশেখর বসু) এবং সত্যজিতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি ফলকও বসানো হয়। যার উদ্বোধন করেছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/11/parash-pathar-3.jpg)
কার্জন পার্কেরও নাম বদলে করা হয়েছে সুরেন্দ্রনাথ পার্ক। ১৯৯৮ সালে পরশ পাথর অঙ্গনের পাশেই তৈরি হয়েছিল ভাষা উদ্যান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়রা অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই ভাষা উদ্যানের সূচনা করেছিলেন। সেই স্বপ্নের গায়ে পড়েছে ধুলোর আস্তরণ। ১৯ মে স্মরণে শিলচর স্মারকেরও ভগ্নপ্রায় দশা।
ভাষা শহীদ স্মারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিত্রা লাহিড়ীর বক্তব্য, "মেট্রো রেলের কাজের জন্যে কার্জন পার্কের বেশীরভাগ অংশই ভাঙ্গা পড়ে আছে। প্রত্যেক বছর ২১ ফেব্রুয়ারির আগে এই ভাষা উদ্যান পরিষ্কার পরিছন্ন করে সাজিয়ে তোলা হয়। প্রশাসনের তরফ থেকেও সাহায্য পাওয়া যায়। মেট্রো রেলের কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে, ততদিন ভাষা উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। কাজ শেষ হওয়ায় পরে এর সৌন্দর্যায়নের দিকে নজর দেওয়া যাবে।"
সত্যজিতের পরশপাথর অঙ্গনের আজ ভগ্নপ্রায় দশা pic.twitter.com/AkD1nbupZh
— IE Bangla (@ieBangla) November 28, 2018
ভাষা উদ্যান তৈরি হওয়ায় পর সে সময়ের ভারতীয় যাদুঘরের ডিরেক্টর শ্যামলকান্তি চট্টোপাধ্যায় খুশি হয়ে একটি অক্ষরবৃক্ষ উপহার দিয়েছিলেন। এছাড়াও এখানে ছিল লালন মঞ্চ। এসবের এখন কোনও অস্তিত্ব নেই। মেট্রো রেলের কাজের জন্যে সব উৎখাত হয়ে গিয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, তিনি বহু বছর এই এলাকায় আসেননি, তবে "যাঁদের এই জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা তাঁরা যদি দেখভাল না করেন, তবে এমন দশা হওয়াটাই স্বাভাবিক।"
রাজ্যের প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী এ প্রসঙ্গে বলেন, "এখানে 'পরশ পাথর' ছবির শুটিং হয়েছিল। পরশ পাথর অঙ্গন একটি 'হেরিটেজ' স্থাপত্য। তার পাশেই ভাষা উদ্যান। যতদিন দায়িত্বে ছিলাম, স্মৃতিসৌধ বা উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে লোক রাখা থাকতো। এখন এসবের কোনও বালাই নেই। এখন যা অবস্থা হয়েছে, তা কিছু মানুষের ভাষা সম্বন্ধে মানসিকতার পরিচয় দেয়। মেট্রো রেলের কাজের জন্যে চারপাশের এমন অবস্থা যে বলে বোঝানো মুশকিল। কাজ শেষ হলে সব ঠিক করে দেওয়া হবে বলে কথাবার্তা চলছে, কিন্তু ততদিনে এই পার্কের কতটা থাকবে সন্দেহ।"
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/11/curzon-park-2.jpg)
ভাষা উদ্যান চত্বর কিংবা পরশ পাথর অঙ্গন পথচলতি মানুষের কাছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার অন্যতম সুবিধেজনক জায়গা হয়ে গিয়েছে। এক অবাঙালি গুটখার পিক ফেলতে ফেলতে বলেন, "কৌন সত্যজিৎ? সবলোগ ইহা পিসাব করনে আতে হ্যায় ইসলিয়ে ইতনা খরাব জগহ্..." এক মধ্যবয়স্ক বাঙালিকে জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে বলেন, "ভাষা উদ্যান! ওটা তো বাংলাদেশে। পরশ পাথর! এটা আবার কোন জিনিস? এমন কোন বাংলা সিনেমার নাম জানা নেই।"