শপিং মল, আকাশ ছোঁয়া অফিসবাড়ি আর ঝাঁ চকচকে ক্যাফের ভিড়ে হাঁপিয়ে ওঠেন যারা, তাঁদের জন্যে এখনও শহর কলকাতা পসরা সাজিয়ে রেখেছে এদিক ওদিক। শোভাবাজার মোড়ের কাছেই অ্যালেন কিচেন যেন এই পসরার একটা অংশ। ১৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছে আলেন। আর এই ২০২০ তেও দিব্যি পাল্লা দিচ্ছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্যাফে সংস্কৃতির সঙ্গে। ভোজনরসিকদের অ্যালেনপ্রীতি কিন্তু শুধু কলকাতাবাসীদের মধ্যেই আটকে নেই। ভিনরাজ্য কিমবা ভিনদেশ থেকে যারা এই শহরে আসেন, তারাও কলকাতার স্বাদ পেতে যে ক'টি হাতে গোনা দোকানে যান তার মধ্যে অ্যালেন অন্যতম।
কলকাতার জলখাবারের মুখরোচক মেজাজের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেছে অ্যালেনসের প্রণ কাটলেট। দেশি ঘিয়ে ভাজা চিংড়ির ফ্রাই। ওপরে বেসনের একেবারে পাতলা স্তর। উফফ...একেবারে স্বর্গের স্বাদ। দেড় শতকে অ্যালেনের মতো প্রন কাটলেট বানাতে পারল না কেন কেউ? প্রশ্নের উত্তরে দোকানের মালিক সুব্রত বাবু বললেন, "এই রেসিপি আর কেউ বার করতে পারেনি এখনও। চিংড়ির কাটলেট ছাড়াও আমাদের দোকানের কবিরাজি, ফিশ কাটলেট, চিকেন রোলের খুব জনপ্রিয়তা রয়েছে। আসলে আমরা খাবারের গুণগত মানের ওপর জোর দিয়ে এসেছি প্রথম থেকেই। পরিমাণে খুব বেশি বানাইনা। কখনও সন্ধে সাতটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। আর বেশিরভাগ খাবার আমরা দেশি ঘিয়ে বানাই। খেয়ে শরীর খারাপ হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না"।
আরো পড়ুন, সাবান দিয়ে হাত ধুলে তবেই পাবেন ফুচকা, সঙ্গে অ্যাকোয়া গার্ডের তেঁতুলজল
দোকানের নাম কোথা থেকে এল? শোনা যায় পরাধীন ভারতে অ্যালেন নামের স্কটিশ এক সাহেব এই দোকান খুলেছিলেন। এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় দোকানের কর্মচারীকে অ্যালেন সাহেব দিয়ে গেলেন তাঁর হেঁসেলের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। সেই থেকে বদলাল দোকানের মালিকানা। জীবনকৃষ্ণ সাহার চতুর্থ প্রজন্ম এখন দোকানের মালিক।
আরও পড়ুন, হাজরা কাফে মানেই ফোম দেওয়া পুডিং, কবিরাজি কাটলেট, আরও কতো কী!
অ্যালেন এর আজকের ঠিকানা ৪০/১, যতীন্দ্র মোহন অ্যাভেনিউ, কলকাতা ৬। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথ। তবে আট-ন' দশক আগেও চিতপুর ছিল এর আসল ঠিকানা। বছরভর বিকেল ৪টে থেকে সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকে অ্যালেন। না, হাল ফ্যাশনের চেহারা নেই, জাঁক জমক নেই এতটুকু। তার বদলে আছে কড়িবরগার ছাদ, পুরোন মার্বেলের টেবিল, রঙ চটে যাওয়া কাঠের চেয়ার। হাইজিন বজায় রাখতে ন্যুনতম বদলটুকুই করেছেন মালিক সুব্রত সাহা। প্রথম জীবনে কলকাতার ফাইভ স্টার হোটেলের শেফ ছিলেন দীপক বাবু। কিন্তু নিজের দোকান সামলাতে গিয়ে বুঝেছেন দোকানের ভোল বদলালে ইতিহাসকে অসম্মান করা হবে, নষ্ট হবে ঐতিহ্য।
অ্যালেনে কেউ আসেন স্বাদের টানে, কেউ আবার সেই কলকাতাটাকে ছুঁয়ে দেখতে, নিত্য আধুনিকতার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে যা। দোকানের কাউন্টারে কোনওদিন থাকেন সুব্রত বাবু, কোনও দিন দীপক বাবু। রাস্তার ওপর হেঁসেলে একমনে ময়দার পুর বানাতে দেখবেন যে বৃদ্ধকে, তাঁর নাম ক্ষুদিরাম হালদার। একেবারে ছোটবেলায় এসেছিলেন দোকানে। থেকে গেছেন আজীবন। এই থেকে যাওয়া, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েও ছেড়ে যেতে না পারার আরেক নাম বোধহয় কলকাতা।