এই তো কয়েকদিন হল, নিজেদের ঘর ছেড়ে এসেছে ওরা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশকর্মীদের পিঠে বসিয়ে যখন ওরা রাজপথে হাঁটবে, সেই রাজকীয় ভঙ্গিমায় বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকবে শহরবাসী। নিশ্চয়ই বুঝেছেন কাদের কথা বলা হচ্ছে। কলকাতা পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনী।
নতুন সদস্যদের পেয়ে রূপমতী, রবিন হুডদের সংসার এখন বেশ জমাজমাট। সদ্য পাঞ্জাব থেকে এগারোটি টগবগে ঘোড়া কিনেছে কলকাতা মাউন্টেড পুলিশ। রূপমতী, রবিন হুড হল কলকাতা পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর নামজাদা ঘোড়া। এবার সেই দলে যোগ দিল ভিনরাজ্যের এই এগারো জন সদস্য। নতুনদের মধ্যে তিনটি মাদী (মেয়ার) এবং সাতটি গেল্ড (নির্বীজকৃত)। একাদশতম নব্য অতিথি হল একটি সাদা রঙের স্ট্যালিয়ন।
কলকাতা পুলিশের নতুন এই বাহিনী প্রসঙ্গে অতিরিক্ত নগরপাল (৪) কে জয়রামন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জানালেন, "নতুন ঘোড়া কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। আপাতত আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের আস্তাবলে রাখা হয়েছে এদের।" শ্রী জয়রামন আরও বললেন, "মাঝে মাঝে আমরা ঘোড়া কিনি ঠিকই, তবে অনেক সময়ই রেসকোর্স থেকে উপহার হিসেবে আমাদের ঘোড়া দেওয়া হয়। সেসব ঘোড়াকে আমাদের কাজে লাগানোর জন্য ফের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।"
নতুন সদস্যদের নিয়ে পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেড়ে হলো ৭৭, যার মধ্যে তেরোটি ঘোড়া ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের পর ১১ বছর বাদে আবার ঘোড়া কিনল কলকাতা মাউন্টেড পুলিশ।
সেই নতুন স্ট্যালিয়ন ঘোড়া। ছবি: শশী ঘোষ
নতুন ঘোড়াগুলির মধ্যে নটি থরোব্রেড, অর্থাৎ উৎকৃষ্ট বংশজাত। বাকি দুটি ঘোড়ার মধ্যে স্ট্যালিয়ন এবং মেয়ার মাড়ওয়ারি ব্রিড জাতের বলে জানা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের ইন্সপেক্টর অভ্র চট্টোপাধ্যায় জানালেন, "আমরা মূলত থরোব্রেড জাতের ঘোড়াই কিনি। যে ঘোড়াগুলো এবার কেনা হল তাদের বয়স তিন থেকে পাঁচ বছর।" প্রসঙ্গত, একটি ঘোড়ার গড় আয়ু ২৫-৩০ বছর।
ঘোড়া কেনার সময় কোন কোন দিকগুলো দেখা হয়? কেমন ভাবে বাছাই করা হয়? অভ্রবাবু জানালেন, "উচ্চতা, হাঁটাচলা, দেহের কাঠামো। ঘোড়ার হাঁটাচলা দেখে আন্দাজ করা যায় সে ভবিষ্যতে কেমন হবে। কতটা সোজাভাবে পা ফেলছে, কতটা বাউন্স আছে, এসব দেখা হয়।"
কারা এই চুলচেরা পরীক্ষা নেন? অভ্রবাবু বললেন, "ঘোড়া কেনার জন্য আমাদের মাউন্টেড পুলিশের একটা দল ঠিক করা হয়। দলে একজন রাইডার, ইন্সপেক্টর, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার এবং চিকিৎসক থাকেন। ওঁরাই দেখে বাছাই করেন।"
আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সে ঘোড়ার আস্তাবলে ঢুঁ মারতেই দেখা হল এক সহিসের সঙ্গে। সহিস বলতে, যিনি ঘোড়ার দেখভাল করেন। তবে শুধু দেখভালই নয়, রীতিমতো ঘোড়াকে গ্রুম করেন এঁরা। রবিন হুডের নাম নিতেই ওই সহিস সগর্বে বললেন, "রবিন হুডকে আমিই তৈরি করেছিলাম। প্রথমে যা ছটফটে ছিল, বাপ রে।"
সহিসদের প্রসঙ্গে শ্রী জয়রামন জানালেন, "প্রতিটি ঘোড়ার জন্য আলাদা আলাদা সহিস রয়েছেন। ওঁরাই দেখভাল করেন।" তবে কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের সহিসের ঘাটতির কথাও বললেন অভ্রবাবু। তিনি জানান, "আমাদের ৫৭ জন সহিস রয়েছেন, যেখানে ঘোড়ার সংখ্যা ৭৭। এজন্য অনেকসময় সিভিক ভলান্টিয়ারদের সাহায্য নিই আমরা।"
ক্যামেরা দেখেই যেন পোজ দিল সে। ছবি: শশী ঘোষ
পুলিশের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে কাজ করতে অবশ্য এই এগারোটি ঘোড়াকে অপেক্ষা করতে হবে প্রায় দু বছর। এ ব্যাপারে অভ্রবাবু জানালেন, "এদের রাইডিং করতেই সময় লাগবে প্রায় এক বছর।" তবে কোন ঘোড়া কত তাড়াতাড়ি প্রশিক্ষিত হবে, সেটা নির্ভর করে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমতার ওপর।
আরও পড়ুন, মুনিয়ার দৌড় আর শিম্পাঞ্জিদের খেলা, জমজমাট চিড়িয়াখানা
ঘোড়ার নামের বহরও কম কিছু নয়। রূপমতী, রবিন হুডের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এই নতুন ঘোড়াদের কী নাম দেওয়া হল? অভ্রবাবুর কথায়, "নতুন ঘোড়া এলে কমপক্ষে একমাস লাগে নামকরণ করতে।" কীভাবে নামকরণ করা হয়? নাম ঠিক করেন কে? জবাবে তিনি জানালেন, "কমিশনার সাহেব নাম ঠিক করেন অনেকসময়। আমরা ৫০-১০০টি নামের প্রস্তাব দিই। তার মধ্যে কোনও একটা বাছা হয়। স্ট্যালিয়ন, মেয়ার, গেল্ডের জন্য আলাদা আলাদা নামের প্রস্তাব পাঠানো হয়।"
আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সে ঘোড়ার আস্তাবলে রাখা হয়েছে নতুন ১১টি ঘোড়াকে। ছবি: শশী ঘোষ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
কলকাতা পুলিশ আজও তার ঘোড়সওয়ার বাহিনীর উপর এতটা নির্ভরশীল কেন? কেনই বা ঘোড়াদের এত যত্নআত্তি? জবাবে শ্রী জয়রামন বললেন, "পুলিশ বাহিনীতে ঘোড়ার প্রচলন তো সেই পুরনো জমানা থেকেই। এটা একটা ঐতিহ্য। এখন মূলত ঘোড়া টহলের কাজেই লাগে। সকালে শহরে ঘোড়ায় করে টহল দেওয়া হয়। ময়দান এলাকা গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত, সেখানে গাড়িতে টহল দেওয়া যায় না। পায়ে হেঁটেও টহল দেওয়া অসুবিধে। ফলে ঘোড়ার দরকার হয়।" ঘোড়ার উপর নির্ভরতা প্রসঙ্গে তিনি এও জানালেন, "টহল দেওয়ার পাশাপাশি, কোনও মিছিল বা জমায়েতে ভিড় সরাতে বা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতেও ঘোড়াকে আমরা কাজে লাগাই। এছাড়াও রুটমার্চে তো লাগেই ঘোড়া। পুলিশ অফিসারদের ট্রেনিংয়ের জন্যও ঘোড়া অপরিহার্য। তাছাড়া বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্টেও ঘোড়ার প্রয়োজন হয়।"
আরও পড়ুন, প্রচার হলো, আইন হলো, আমরা মানলাম কি?
আপাতত নতুন সদস্যদের নিয়ে সরগরম কলকাতা পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনী। সকাল-সন্ধে তাদের চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। ওই সাদা ধবধবে টগবগে স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটির প্রতি যেন বিশেষ নজর। সামনে যেতেই এক সহিসের সাবধানবাণী, "খুব সামনে যাবেন না, একটু দূরে থাকুন এর থেকে।" এরা এখন কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের ভবিষ্যৎ। সামনে বড় পরীক্ষা। দীর্ঘ প্রশিক্ষণ পর্বে উত্তীর্ণ হলেই খাকি উর্দিধারীদের পিঠে বসিয়ে এরা শহর পরিক্রমায় বেরোবে।