মহা বিপদে পড়েছেন কলকাতাবাসী। শহরের অন্যতম জনপ্রিয় যানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার প্রশাসনিক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছেন পরিবহণ কর্মীরা। দ্রুত কোনও বিকল্পের ব্যবস্থা না করতে পারলে নাকালের একশেষ হবেন নিত্যযাত্রীরা। ঘোর সঙ্কটের মুখে প্রশাসনও।
চেনা লাগছে ছবিটা? সাম্প্রতিক মনে হচ্ছে? নিজেকে তবে ফিরিয়ে নিয়ে যান ১৮২৭ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে। যে যানের কথা বলছি, তা হলো পাল্কি। অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করেছিলেন অসংখ্য পাল্কি বেহারা, যার ফলে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা। অনেকের মতেই এটি সম্ভবত ভারতের প্রথম পরিবহণ ধর্মঘট।
শেষমেশ বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন ব্রাউনলো সাহেব, যাঁর বুদ্ধিতে পাল্কির আকারের বাক্সের সঙ্গে চারটি চাকা জুড়ে দিয়ে তার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল একটা ঘোড়া। ব্যস, মুশকিল আসান। শুরু হয়ে গেল কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির আনাগোনা। শহরবাসী পরিত্রাণ পেলেন পাল্কি বেহারাদের জুলুমের হাত থেকে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো কলকাতার ট্র্যাফিক ব্যবস্থার।
এই উপক্রমণিকা নিছক ইতিহাসের কচকচি নয় কিন্তু। এমন চিত্তাকর্ষক আরও অনেক তথ্যের আধার লুকিয়ে আছে শহরের এক কোণায়। 'লুকিয়ে আছে' বলাটা ভুল হলো। সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে রিপন স্ট্রিটের ওপর, আদতে আঠারো শতকে তৈরি সাদা ধবধবে, সুদৃশ্য, প্রাসাদোপম বাড়ি। কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামে আপনাকে স্বাগত। শুধু মিউজিয়াম নয় অবশ্য, 'থ্রি-ইন-ওয়ান' বলা ভালো। একতলায় সংগ্রহশালা, দোতলায় লাইব্রেরি-রিডিং রুম এবং ক্যাফেটেরিয়া, প্রবেশ অবাধ। সারাদিনের রসদ, বছরের ৩৬৫ দিন খোলা, সকাল এগারোটা থেকে। চাইলে বছরে ৮০০ টাকার বিনিময়ে লাইব্রেরির মেম্বারশিপ।
অনেকেই হয়তো এতদিনে জানেন এই বাড়ির ইতিহাস। যাঁরা জানেন না, তাঁদের সবিস্তারে না বললেও এটুকু বলা আবশ্যক, যে এই বাড়ির সঙ্গে 'সন্ন্যাসী রাজা' এবং 'এক যে ছিল রাজা' খ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। কলকাতার আদালতে তাঁর বহুচর্চিত মামলা চলাকালীন একাধিকবার এই বাড়িতে ছিলেন তিনি। বেশ কিছু হাত ঘুরে বাড়িটি কলকাতা পুলিশের কাছে আসে ১৯৪৮ সালে। তার পরের ৭০ বছরের ইতিহাস জানতে পারবেন বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই। জানতে পারবেন, কীভাবে ভগ্নপ্রায় এই বাড়ি হয়ে উঠল আজকের ঝকঝকে মিউজিয়াম।
জানতে পারবেন আরও অনেক কথাই। পরিসর যে খুব বড় তা এখনও বলা যায় না, কিন্তু নিখুঁত উপস্থাপনার গুণে বাড়িটির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি ইতিহাসের এমন এক ভাণ্ডার, যা আপনার নাগালের মধ্যে, এবং মোটা মোটা বইয়ের পাতায় আবদ্ধ নয়। রয়েছে শহরের প্রথম ফুটপাথ তৈরির গল্প, রাস্তার 'রাইট সাইড' এবং 'রং সাইড' সম্পর্কিত কমিশনারের নির্দেশ, পুলিশ এবং পরবর্তীকালে ট্র্যাফিক পুলিশের ব্যবহৃত নানা অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া অস্ত্রশস্ত্র, নেতাজী সংক্রান্ত দলিল, 'লল বাজার' থেকে 'লালবাজার' হয়ে ওঠার কাহিনি, শহরে প্রথম ট্রামের উৎপত্তি, আরও বিবিধ রতন। তালিকা দীর্ঘতর করার লোভ সামলানো কঠিন, কিন্তু তাতে নিজে গিয়ে দেখার আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। সে রাস্তায় আর হাঁটলাম না।
মজাটা হলো, আপাতদৃষ্টিতে কলকাতা পুলিশের বিবর্তনের গল্প বলে এই মিউজিয়াম, কিন্তু তার সঙ্গে শহরের বিবর্তনও যে কতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, সে গল্পও চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছবির মতো। মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর দিলীপ মিত্র জানালেন, দিনে ২০-২৫ জন মিউজিয়াম দেখতে আসেন এখন। বলা বাহুল্য, দর্শনার্থীর সংখ্যা যত বাড়ে ততই মঙ্গল। এখানে দিলীপবাবুর বক্তব্য, "শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কন্ডাক্টেড ট্যুর করানো হবে এই মিউজিয়ামে।"
ঘুরে আসুন রিপন স্ট্রিটের পুলিশ মিউজিয়ামে, যেখানে অতীতের হাত ধরে থাকে বর্তমান, ইতিহাস অনায়াস বন্ধুত্ব পাতায় ছবিতে-কথায়-নথিতে। ঘুরেই আসুন। সময়টা খারাপ কাটবে না, গ্যারান্টি।
মিউজিয়াম খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে রাত আটটা। লাইব্রেরির সদস্য হতে গেলে বার্ষিক চাঁদা ৮০০ টাকা