তরুণ প্রজন্মের চোখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তত্ত্ব নিয়ে অন্তহীন লেখালেখি, আলোচনা, তর্ক বিতর্ক, বাদানুবাদের বহমান ধারার মাঝেই ফের একবার ঘুরে এলো পঁচিশে বৈশাখ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, রবি ঠাকুর নিজেই জানতেন যে তাঁর কবিতা বা অন্যান্য লেখার জন্য যত না হোক, তাঁর গানের জন্য তাঁকে মনে রাখবে আগামি। সুনীল এও একবার বলেছিলেন, তিনি চান, জিনস পরে, মাথা ঝাঁকিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে তরুণ প্রজন্ম, সেখানেই রবীন্দ্রনাথের মতো মুক্তমনা স্রষ্টার সার্থকতা।
রবীন্দ্রসঙ্গীত যে আজও অজস্র বাঙালির নিয়মিত সঙ্গী, সেই আশ্বাস আমাদের চারিদিকে। জিনস পরে মাথা ঝাঁকিয়ে না হলেও, তাঁকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছেন একাধিক তরুণ প্রজেন্মর শিল্পী। পরীক্ষামূলকভাবে গেয়েছেন তাঁর গান। কলকাতায় সেই তালিকায় নিশ্চিতভাবে রয়েছেন সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ, যাঁরা এবছর পঁচিশে বৈশাখে প্রকাশ করেছেন 'ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা' গানটিকে ভিত্তি করে একটি মিউজিক ভিডিও, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে মিশছে মসজিদের আজান বা পাশ্চাত্য গসপেল মিউজিক। এবং সমগ্র গানের সঙ্গে মিশছে ছবিও।
মূলত প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবেই তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত পছন্দের এই গানটিকে দেখেছেন সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ। "বর্তমানের টালমাটাল সময়ে এই গানের প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। আমাদের নড়ে যাওয়া সমাজের ভিত ফের গড়ে তোলার প্রার্থনাই যেন জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই গানের মধ্যে কখনো আসছে আজান, কখনো গসপেল সঙ্গীত," বলেন সৌম্যজিৎ। উল্লেখ্য, গত বছর ভাইরাল হয় সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিতের আরেকটি মিউজিক ভিডিও, যেখানে 'চিরসখা হে' অবাধে মিশে গিয়েছিল ফতেপুর সিক্রির সুফি গায়কের কণ্ঠের সঙ্গে।
ধর্মকেই বেছে নেওয়া কেন? সৌম্যজিতের কথায়, "ধর্মের সঙ্গে যে কোনো শিল্পের গভীর সম্পর্ক। সে মন্দির-মসজিদের কারুকার্য হোক বা গানবাজনা। সেদিকটা তুলে ধরার ইচ্ছে ছিল। সৌভাগ্যক্রমে পঁচিশে বৈশাখের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলে গেল সময়টা।" সেজন্যই কি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানই বাছা? না, বলেন সৌম্যজিৎ। "সম্ভবত পৃথিবীর কোনো লেখক বা কবির কাজকে এভাবে পর্যায়ে ভাগ করা হয় নি যেভাবে রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতাকে করা হয়েছে, যে এটা প্রেম পর্যায়ের গান বা অমুকটা পূজা পর্যায়ের গান। এই চিন্তাধারা আমরা খুব একটা মানি না। কোন গান কী বার্তা দিচ্ছে, তা ঠিক করে নেওয়ার স্বাধীনতা একজন শ্রোতার থাকা উচিত।"
দুই শিল্পীর বক্তব্য, গানটি বাছার আসল কারণ রবীন্দ্রনাথের 'সুফি সত্তার' উন্মোচন। "আমাদের মতে, বাংলায় সুফি ভাবধারার অন্যতম নিদর্শন হলেন রবীন্দ্রনাথ। সুফি মতবাদের মূল তত্ত্ব - প্রেম এবং পূজার অনায়াস সংমিশ্রণ - ওঁর গানে যতটা পাই, সেরকম আর কোথাও নেই," বলেন সৌম্যজিৎ। "তাছাড়া, 'সংগীত-চিন্তা'য় রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলছেন, সমাজের ওপর সঙ্গীতের, এবং সঙ্গীতের ওপর সমাজের প্রভাব যদি না পড়ে, তবে সে সঙ্গীত যুগোপযোগী হয়ে ওঠে না।"
১৮৬১ থেকে ১৯৪১-এর সময়কালে আবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ভাবিত নন এই দুুুই শিল্পী। সৌম্যজিৎ বলছেন, "আমাদের সবার ভেতরে যে রবীন্দ্রনাথ, আমরা তাঁকে নিয়ে ভাবি। আমাদের রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাজকে এই যুগে এসে আমরা যেভাবে দেখছি, আমাদের কাছে সেটাই সত্যি।" তাঁদের রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে তাই সহজেই মেশে আজান। স্রেফ একটি চার্চ অর্গানকে সঙ্গে নিয়ে গাওয়া যায় 'ধায় যেন মোর...' সেসময় পর্দায় ভেসে ওঠে কলকাতার রাজপথে সাজানো রবি ঠাকুরের ছবি। আপামর জনসাধারণের রবীন্দ্রনাথ, স্রেফ বিদগ্ধজনের সম্পত্তি নন।