তীর গতিতে ধেয়ে আসা গাড়ি, অন্তত ধরে নেওয়া যায় তাই।.তার পথ আটকে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মী। পকেট থেকে পেন বের করে ছোট্ট নোটবুকে 'কেস' লিখছেন। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গতি ধরে রাখতে পারেননি চালক, তাই গুণতে হচ্ছে জরিমানার টাকা। এই দৃশ্যের পাশেই পায়ে বল নিয়ে মেজাজি লিওনেল মেসির আক্রমণাত্মক ভঙ্গির ছবি, নিচে ক্যাচলাইন: ‘স্পিড লিমিট মানতে হয়, সবাই তো আর মেসি নয়।’
এটি স্রেফ একটি নমুনা, চলতি ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনাকে হাতিয়ার করে ফেসবুকে পথ নিরাপত্তা নিয়ে কলকাতা পুলিশ এবং ট্র্যাফিক পুলিশের অভিনব প্রচারের। শুধু এটাই নয়, ‘সাবধানের নেই মার’ বা ‘ফালতু কেন ঝুঁকি নেবেন, সবাই কি আর সিআর সেভেন?’ অথবা ‘কম হোক রেষারেষি, উইকএন্ডে রোনাল্ডো মেসি!’ কিংবা ‘সব পেনাল্টি মিস হয় না!’...মেসি-রোনাল্ডো-নেইমারদের ব্যবহার করে পথ নিরাপত্তা নিয়ে এমন অভিনব প্রচার কৌশল নজর কেড়েছে সবার। পুলিশের রসবোধ নিয়েও চর্চা হয়েছে সর্বত্র। কিন্তু এত কিছুর পরও শহরের রাজপথে দুর্ঘটনা কি কমছে? তার চেয়েও বড় কথা, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে কি সচেতনতা বেড়েছে, বা নিয়ম ভাঙার প্রবণতা কমেছে?
শহরের রাজপথে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ পোস্টারের ছড়াছড়ি। শুধু তাই-ই নয়, ট্র্যাফিক পুলিশের তরফে হাজারো সচেতনতামূলক বাণী ঘোরাফেরা করছে রাস্তায়। কিন্তু আদৌ লাভ হচ্ছে? প্রশ্ন করতেই ডিসি ট্র্যাফিক সুমিত কুমার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জানালেন, "আগের থেকে দুর্ঘটনা অনেকটা কমেছে। গত বছরের নিরিখে এ বছর দুর্ঘটনায় মৃতের হার কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশের মতো, যা খুবই ভাল। আর আমাদের প্রধান লক্ষ্য দুর্ঘটনায় মৃতের হার কমানো।"
সুমিত কুমার এও জানালেন যে পথ নিরাপত্তা নিয়ে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। স্পিড কমানো, ওভারলোডিং, হেলমেট পরা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, এসব নিয়ে বিশেষভাবে ট্র্যাফিক পুলিশের উদ্যোগের কথাও বললেন তিনি। বাসে-বাসে রেষারেষির মতো মারণব্যাধি ঠেকাতে সম্প্রতি বেসরকারি বাসে কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। কমিশনের বদলে বাস মালিক সংগঠনগুলিকে বেতন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন খোদ পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী।
আরও পড়ুন: ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই? তাহলে বাইক কেনার কথা ভুলে যান!
সবই ভালো, কিন্তু আমাদের নিয়ম ভাঙার স্বাভাবিক প্রবৃত্তির কী হবে? উদাহরণস্বরূপ, শহরের বুকে স্টিয়ারিংয়ে হাত দেওয়ার সঙ্গে সিটবেল্ট বেঁধে নেন চালক। কিন্তু শহরের গণ্ডি পেরোলেই, বিশেষত হাইওয়েতে, বেল্ট খুলতে দেরি করেন না। এ প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রীমা মুখোপাধ্যায় বলেন, "আমাদের মাইন্ডসেটই হয়ে গেছে নিয়ম ভাঙার। শহরের রাস্তায় যেমন পুলিশ নজরদারি চালায়, তেমনটা হাইওয়েতে করলে বোধহয় এ সমস্যা অনেকটা ঠেকানো যেতে পারে।" হাইওয়েতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের পরিবহণ দফতরের ওই আধিকারিক। তিনি বলছেন, "ইতিমধ্যেই রাজ্যের ৪০টি থানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা হাইওয়েতে নজরদারি চালাবে।"
বাইক নিয়ে নিয়ম ভাঙার ছবি তো রোজনামচা হয়ে গেছে। এবং দু’চাকার রেসে দুর্ঘটনাও কিছু কম হচ্ছে না। তাই বাইক দুর্ঘটনা ঠেকাতে কড়া হয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। এবার থেকে লাইসেন্স না থাকলে বাইক কেনার ছাড়পত্র মিলবে না, কেন্দ্রের এই আইনই এ রাজ্যে বলবৎ করা হবে। এমন প্রেক্ষাপটেই দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কতটা কমেছে, এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রাজ্য পরিবহণ দফতরের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানালেন, "অনেকটাই কমেছে। দুর্ঘটনায় মৃতের হারও কমেছে।" ২০১৭ সালের জানুয়ারি-মার্চের নিরিখে এ বছরের জানুয়ারি-মার্চের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি জানিয়েছেন, গত বছর জানুয়ারি-মার্চে দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৪,১১২টি, মৃতের সংখ্যা ছিল ১,৬৮৩। এ বছরে ওই তিন মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,৪২৪-তে, এবং মৃতের সংখ্যা কমে হয়েছে ১,৪৮১।
দুর্ঘটনা ঠেকানোর জন্য রাজ্য পরিবহণ দফতর যে আরও কড়া হচ্ছে, তারও আন্দাজ মিলল ওই আধিকারিকের কথায়। তিনি জানালেন, "মোটর ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষকদের জন্য খড়গপুর আইআইটি-তে তিন দিনের বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি, বিশেষ বইও তৈরি করা হয়েছে, যাতে ড্রাইভিংয়ের গুণগত মান আরও উন্নত করা যায়।" এ প্রসঙ্গে ওই আধিকারিক আরও জানালেন, "আমরা এখন দুর্ঘটনার ডেটা অ্যানালিসিসের কাজ শুরু করেছি। তাছাড়া মোটর ট্রেনিং স্কুলগুলিতে বিশেষ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।"
কলকাতা তো বটেই, মফস্বলের অলিগলিতে আজকাল মোটর ট্রেনিং স্কুল গজিয়ে উঠছে। কতখানি ড্রাইভিং শেখানো হয় সেখানে? লাইসেন্স পাওয়ার পরীক্ষায় কতখানিই বা স্বচ্ছতা থাকে? উত্তরে পরিবহণ আধিকারিক জানালেন, "ড্রাইভিং টেস্ট যেখানে করা হয় সেখানে ইতিমধ্যেই ১৪টি জায়গায় সিসিটিভি বসানো হয়েছে, আরও ৩৩টি জায়গায় বসানোর সার্ভে করা হচ্ছে। নজরদারি করলেই স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে।"
এরপরই ওই আধিকারিক জানান, "৩১ মার্চ, ২০১৭ পর্যন্ত রাজ্যে ৪২৮টি মোটর ট্রেনিং স্কুল ছিল। যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই টাকা দিয়ে কোর্স করলেও ক্লাস হয় না। ওই সব স্কুলে বিশেষ পরিদর্শন চালিয়ে আমরা তিনটি বিভাগে ভাগ করেছি। ভাল, মোটামুটি, এবং খারাপ, এভাবে বেছেছি। অনেক স্কুলেই লোক নেই, পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। ওই সব স্কুলকে এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য, তা না হলে বন্ধ করে দেওয়া হবে।" একইসঙ্গে তিনি যোগ করলেন, "বেহালায় একটা ইন্সটিটিউট তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ড্রাইভিং টেস্ট করা হবে। গাড়ির মেকানিক্যাল ফিটনেস টেস্টিংও করা হবে। বারাসতেও এমন কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে রাজ্যের অন্যত্রও হবে।"
আরও পড়ুন, শহরে বাতিস্তম্ভের জয়েন্ট বক্স খোলা, যত্রতত্র কেবল, দায় কার?
কিন্তু কেন এত চেষ্টার পরও কিছু মানুষ হেসেখেলে আইন ভাঙছেন? রীমা দেবী বলেন, "কিছু মানুষের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, আইন ভাঙার মাইন্ডসেট রয়েছে। এজন্য স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের সচেতন করা জরুরি।" বাসচালকদের রেষারেষি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "অনেক সময়ই দেখা যায়, হেল্পাররাই বাস চালাচ্ছেন। চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় তাঁদের যোগ্যতা সেভাবে যাচাই করাই হয় না।" এবং পুলিশের এত প্রচার সত্ত্বেও সর্ষের মধ্যে ভূত দেখছেন রীমা দেবী। তাঁর মতে, পুলিশের একাংশের মধ্যেই স্বচ্ছতা নেই। অনেকসময়ই দুটো টাকা হাতে গুঁজে দিলেই আইন ভাঙার শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
কিন্ত পুলিশের তরফে প্রচারের ফলে আগের চেয়ে মানুষ সচেতন হয়েছেন বলেই মনে করছেন রীমা দেবী। তাঁর মতে, "১০ বছর আগে তো কেউ সিটবেল্ট পরতেনই না, এখন সকলেই মোটামুটি পরেন। প্রায় সকলেই হেলমেট মাথায় দেন।" প্রচারে অনেকটাই কাজ হয়েছে বলে মনে করেন সুমিত কুমারও। তাঁর মতে, "সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতার প্রয়োজন। সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।" পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, "সিগন্যাল খোলা, গাড়ি যাচ্ছে, তখনও অনেকে রাস্তা পারাপার করেন। আসলে আমাদের নিজেদেরকেও সচেতন হতে হবে, তাহলেই হয়তো দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব।"