ওঁরা পাহাড় ভালবাসেন। প্রতি বছর এ রাজ্যে যখন শীত আসব আসব করে, তখনই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়েন পাহাড় সফরে। নিজেদের রুটিন লাইফের মাঝে একটা ব্রেক। ওঁরা তখন না কলকাতা পুলিশের সাদা উর্দিধারী, না চিকিৎসক, না ব্যাঙ্ককর্মী। পিঠে ব্যাগ, হাতে লাঠি নিয়ে তখন সকলেই ট্রেকার।
রুটিন মতো এ বছরের নভেম্বরেও ওঁরা পাহাড়ে চড়তে গিয়েছিলেন। তবে এবারের পাহাড় সফর এক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ওঁরা কলকাতার ‘বোহেমিয়ান’ দল। যাঁদের এবারের গন্তব্য ছিল উত্তরাখণ্ডের দেওরিয়াতাল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের এক রায়ের দৌলতে ওঁদের মাথায় দারুণ আইডিয়া খেলল। দূষণের জেরে দেওরিয়াতাল এলাকায় কোনও ক্যাম্প করা যাবে না বলে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। যে এলাকায় প্লাস্টিক, মদের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
হাইকোর্টের রায় জানার পর বোহেমিয়ানরা ঠিক করলেন, সমস্ত বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। সেইমতো ট্রেকিং করতে গিয়ে কয়েকশো প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে ওই এলাকার সরকারি ডাস্টবিনে ফেলেছে ওই ট্রেকিং দল। অন্যের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের সামগ্রীই নয়, নিজেরাও যে প্লাস্টিক নিয়ে গিয়েছিলেন, তাও যত্ন করে রেখে ফেরত এনেছেন। এমন কীর্তির প্রশংসা করেছেন উত্তরাখণ্ড পুলিশ ও বন কর্মীরাও।
বোহেমিয়ান দলের নেতৃত্বে রয়েছেন কলকাতা পুলিশের পার্ক স্ট্রিট থানার সাব ইন্সপেক্টর অঞ্জন সেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে এ প্রসঙ্গে বললেন, "প্রতিবছরই আমরা ট্রেকিং করি। কিন্তু আমাদের সেভাবে কোনও উদ্দেশ্য থাকে না। এবার দেওরিয়াতাল যাব ঠিক করেছিলাম। পরে জানলাম যে দূষণের জেরে ওই এলাকায় কোনও ক্যাম্পিং করা যাবে না বলে রায় দিয়েছে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট। জানার পর মুশকিলে পড়েছিলাম। কারণ ওখানে আমাদের ক্যাম্প করার কথা ছিল। যেহেতু উদ্দেশ্যটা ভাল, যে প্লাস্টিক ব্যবহার করা যাবে না, আমরা ঠিক করলাম, যে প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছি তা তো ফেরত আনবই, পাশাপাশি যা যা রাস্তায় পাব তা সংগ্রহ করব। এভাবে তিন জায়গায় আমরা প্লাস্টিক কুড়িয়েছি।"
আরও পড়ুন: সাইকেলে নদিয়া থেকে দীঘা, সচেতনতার বার্তা দিতে নজির রকির
কোথায় কোথায় প্লাস্টিক কুড়োলেন? জবাবে অঞ্জনবাবু জানালেন, "দেওরিয়াতাল, চোপ্তা ও চন্দ্রশিলায় ট্রেকিং করতে গিয়ে কুড়িয়েছি। কয়েকশো প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করি আমরা। সেগুলো সরকারের রাখা ডাস্টবিনে ফেলেছি। আমরা জ্যাকেটে করেও বর্জ্য নিয়ে এসেছি। উত্তরাখণ্ড পুলিশ ও বনকর্মীরা খুব প্রশংসা করেছেন আমাদের।"
পাহাড়কে ভাল রাখতে হবে, এটাই উদ্দেশ্য। তাই অঞ্জনবাবু বললেন, "পাহাড়প্রেমীদের মধ্যে এই সচেতনতা খুব জরুরি। আমরা চাইছি, প্রত্যেক ট্রেকার যদি নিজের বর্জ্যটাও নিয়ে আসেন, তাহলে পাহাড় নোংরা হয় না।"
এবারের সফর আরও একটা কারণে বিশেষ। প্রথমবার দলের নামকরণ করেন ওঁরা। বোহেমিয়ান নাম কেন? জবাবে দলের আরেক নেতা তথা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দেবমাল্য মাইতি বললেন, "খাঁচা থেকে বেরিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছেটা আমাদের সকলের মধ্যেই রয়েছে। বেশ কিছু নাম নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। বোহেমিয়ান নামটাই সবার পছন্দ হয়। আসলে সকলেই আমরা ফ্যামিলি ম্যান। কিন্তু মাঝেমধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতে মন চায়। আমরাও যদি বছরের শেষে পাঁচ দিনের ট্রেকিং করি, তাহলে বেশ লাগে। নামটা আমারই প্রস্তাব করা।"
আরও পড়ুন: ব্রিটেনের বিশ্বজয়ীর নেতৃত্বে বরফ সাম্রাজ্য অভিযানে দুই ভারতীয় কন্যা
দলের সদস্যদের জন্য বানানো হয়েছে বিশেষ রঙের টি-শার্ট। দেবমাল্যবাবু বললেন, "প্রকৃতিকে ভালবেসেই এই প্রচার। একজনও যদি আমাদের দেখে সচেতন হন, তাহলে দারুণ হবে।"
১৮ থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত এই সফরে অঞ্জন সেন, দেবমাল্য মাইতি ছাড়াও দলে ছিলেন চিকিৎসক সমিত চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা পুলিশের এসআই রিজওয়ান মোল্লা, পুলিশকর্মী মফিদুল ইসলাম, ব্যাঙ্ক কর্মী সন্দীপ প্রামাণিক, ভাঙড় কলেজের লাইব্রেরিয়ান শাহিদ হাসান ও মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ স্মরনিক চৌধুরী।