“সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র”। আমার জয় সর্বত্র হয়েছিল কিনা বলতে পারবনা, কিন্তু মুখটা খারাপ ছিলনা। বেশ সামঞ্জস্য ছিল... ভরাট, লাবণ্যময়, এক গাল হাসি, আঁকা ভুরু, বড় বড় চোখ। ছিল। এপ্রিল ২০, ২০১৮ অবধি।
না, তারপর মুখটা পুড়ে যায়নি। কেউ অ্যাসিডও ছোঁড়েনি। আমার সৌভাগ্য!
হঠাৎ এক রাতে খাবার খেয়ে মুখ ধুতে গিয়ে দেখি, আঁকা ভুরু নেমে এসেছে, কয়েক মিনিটের মধ্যে ডানচোখে সর্ষেফুল দেখলাম, মুখের হাসি খসে পড়ল।
দৌড়লাম এমার্জেন্সিতে। ধরা পড়ল “বেলস্ পালসি”, অর্থাৎ, মৌখিক পক্ষাঘাত। “সেরে যাবে, তিন-চার মাসের মধ্যে সেরে যাবে,” বললেন আমার পারিবারিক ডাক্তার। “এটা সাময়িক। আরে, আপনি হাসবেন পরে ভেবে...” তিনি আশ্বাস দিলেন।
যেহেতু এটা জীবন-সঙ্কটকারী অসুখ নয়, সেহেতু এমার্জেন্সির ডাক্তারগণও হেসে অন্য রোগির দিকে চলে গেলেন। আমি ভাঙা গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। তিন-চার মাস লাগবে সারতে? কোন ওষুধ নেই দ্রুত আরোগ্যের জন্য? কোন ইঞ্জেকশন, স্টেম সেলস… এই একবিংশ শতাব্দীতে কোন চিকিৎসাই নেই বেলস্ পালসির?
স্টেরয়ডস, আন্টি-ভাইরাল দিয়ে এক-সপ্তাহ বাদে কানাডার মতন প্রথম-বিশ্ব দেশের ডাক্তার বললেন, “ও নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।” তাতে বিশেষ কিছু কাজ হল বলে মনে হয়নি।
চোখের পাতা পড়ছেনা। না, ভয় বা আশঙ্কায় নয়, ওটা ব্যাধিরই একটা অংশ। চোখের পাতাও পক্ষাঘাতগ্রস্ত। এর ফলে চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে, এবং চোখের মণির মাঝখানে কিছুটা ছড়েও গেছে। কিন্তু চিন্তার কোনো কারণ নেই। সেরে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
চোখের কিছু ড্রপ দিলেন ডাক্তার। বললেন এছাড়া আর কিছু করার নেই। ধৈর্য ধর, সহ্য কর। ২৪ ঘণ্টা চোখের ওপর জলদস্যুদের মতন কালো প্যাচ। এক চোখে, বা মাঝে মাঝে অন্ধের মতন হাতড়ে হাতড়ে বাড়ির কাজ করা। একচোখে ইন্টেরনেট ঘেঁটে ঠাহরে এল যে পৃথিবীর কোথাও এর কোন অন্য চিকিৎসা নেই। এক কথায়, ‘ক্রেনিয়াল নার্ভ‘ এনাদের সিলেবাসের বাইরে। যথোপযোগী ওষুধ বা রিসার্চ নেই -- সবই আল্লার ভরসা।
সেই কলেরা-যুগে চলে এলাম। টোটকা, হোমিওপাথি, হলুদ-দুধ, যে যা বলছে করছি। মুখের কোন হেলদোল নেই। কথা বলতে জড়িয়ে যাচ্ছে, ডান নাকে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, মুখে খাবার ঢোকাতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে, ডান গালে খাবার ঢুকে গেলে বের করতে পারছিনা, জল খেতে গিয়ে জামা ভিজে যাচ্ছে, এক কথায় আমি “সাময়িক বিকলাঙ্গ”।
কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ কিছু নয়। এটা সেরে যাবে।
বিদেশে থাকি বলে রেঁধে বেড়েও খেতে হচ্ছে আমাকেই। এক চোখ দিয়ে রান্না করছি। দূরত্ব ঠাওর করতে না পেরে বহুবার ছ্যাঁকাও খাচ্ছি। তাছাড়া কানের পিছন থেকে গোটা মুখে, মাথায়, ভয়াবহ নার্ভ পেন, অহরহ চোখে জ্বালা। আমার পরিবারই একমাত্র সম্বল।
এ গেল প্রথম মাস। দ্বিতীয় মাসে প্রথমবার আমার ডানদিকের ঠোঁটটা একটু সাড়া দিল। চুল-চেরা নড়ন দেখা দিল। তখন চোখে একটু-আধটু দেখতে পারছি। ইউটিউব দেখে দেখে তখন থেকে শুরু করলাম নিজের মতন করে ফিজিওথেরাপি। এখানকার ডাক্তার তো বলেছে কিচ্ছু করতে হবেনা, শুধু সহ্য করে যাও। আমার ভাসুর কলকাতা থেকে বললেন, “নিজে নিজে তো সারবে, কিন্তু মাসলগুলোকে একটু সাহায্য তো করতে হবে।” সেই কথায় ভর করে নিজে নিজেই মুখের ফিজিও করতে করতে ভালো হতে শুরু করলাম।
আড়াই মাস পরে এখন আমি খানিক সুস্থ। হাসি আবার গাল বেয়ে বেশ খানিকটা উঠছে। চোখের জ্বালা অনেক কমেছে, কানের ব্যাথা নিয়ন্ত্রণে। আবার লিখতে পারছি, টিভি দেখতে পারছি, কম্প্যুটারে বসতে পারছি।
অর্থাৎ ডাক্তার যা বলেছিলেন তাই হচ্ছে। সেরে উঠছি। ভয় পাওয়ার কিছুই ছিলনা। শুধু ৮০ দিন (আজ অবধি), ১,৯২০ ঘন্টা আমি মুখ দেখাতে পারিনি কাউকে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম, শুধু কোন ঘোর অসুখ হয়নি তো, এই দুশ্চিন্তায়। কবে ঠিক হব, কবে আবার হাসতে পারব, কবে আবার ভালোভাবে খেতে পারব, কথা বলতে পারব, সে ব্যাপারে কারো কোন আশ্বাস ছিলনা। তবে, বেল্স্ পালসি কোন গুরুত্বপুর্ণ ব্যাধিই নয়, এটা সেরে গেলেই ঠিক হয়ে যায়। তাই ডাক্তারদের সিলেবাসের বাইরে। আমি ভাগ্যবতী আমার বেল্স্ পালসি হয়েছে।
কাবেরী দত্ত চট্টোপাধ্যায়
মিসিসাগা, কানাডা।