দেশে ওদিকে হিন্দুত্ব নিয়ে দাবানল জ্বলছে, এদিকে ক্যানাডিয়ান সাহেবরা কৃষ্ণ শিবিরে ‘পোজ্’ করে ছবি তুলছে।
এই একটা চিরকালীন লোভনীয় দৃশ্য থেকে গেল - ইস্কনের সাহেব সন্ন্যাসীদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ছোটবেলায় - সেই সময় থেকে। সাহেবরা আমাদের কোন বিষয়ে কোনও ঔৎসুক্য প্রকাশ করলেই আমরা কৃতজ্ঞ। সাহেবরা জানে মানে আমরা ধন্য। কিন্তু সাহেবরা সত্যি অনেক কিছু জানে না। আমরা ভারতবর্ষকে অনেক সময় ‘দুনিয়া’ বলে সম্বোধন করি। “ইয়ে দুনিয়া, ইয়ে মেহফিল, মেরে কাম কি নাহিন...”। ‘দুনিয়াটা’ যে কতটা বিশাল, তা ভারতের বাইরে বসবাস করা শুরু করলেই বোঝা যায়। ‘হিন্দু’, না ‘হিন্দি’, কোনটা ধর্ম আর কোনটা ভাষা তা অধিকাংশ সাহেবই গুলিয়ে ফেলে। বলিউড জানে, নাচ-গান দেখলেই জিজ্ঞেস করে, “এটা কী ভাষা? ইন্ডিয়ান?” মুশকিল! ইন্ডিয়ান বলে যে কোন ভাষা নেই রে! তবে কী ভাষা? ওনাদের শেখানোর জন্য গুগল ঘেঁটে নতুন করে শিখতে হয় ভারতে কটা ভাষা আছে।
এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। আমরা ভারতে অনেকেই জানিনা ‘চাইনিজ’ বলে কোন ভাষা নেই। ভাষাটা ‘ক্যান্টোনিজ’ অথবা ‘ম্যান্ডারিন’। অথচ, চীন ভারতের থেকে অনেক বৃহত্তর দেশ।
তারপর তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। দুর্গার দশটা হাত, না দশটা মাথা? শিবের দশটা হাত নেই? কেনো? মা কালী’র অতগুলো মুণ্ডমালা দেখে আতঙ্কিত! আমরা ইঁদুরকে পুজো করি? সাপকেও পুজো করি? হাতি-মাথা গণেশকে নিয়েও গল্প শুনতে চায়।
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: কানাডায় ইউথেনেসিয়া
দোহাই সাহেবগণ! আমি না গুগল, না ‘ভক্ত্’। আমাকে মাপ কর। কিন্তু বললে কী হবে, হিন্দুত্ব তাদের আকর্ষণ করে। তেত্রিশ কোটি দেবতা, মুখের কথা? কত গপ্প। কত মজার ব্যাপার! কোন দেবতার ক’টা হাত, কোন দেবতার ক’টা চোখ -- আমার সাথে দেখা হলেই ঝালিয়ে নেয়।
আমি বাবা আর দানবদের কথা বলিনি!
আসলে আমারই দোষ। আমরা বাঙালিরা বড্ড নাস্তিক গোছের। হিন্দুত্বের গন্ধ নেই আমাদের জীবনে। গরু খাই, মদ খাই, সিগারেট খাই। সুফি গাই, চার্চে যাই। ধূপ জ্বালাই, আবার মোমবাতিও জ্বালাই । ঈদে বিরিয়ানি খাই, পুজোয় রোল খাই , বড়দিনে কেক খাই, ধেই ধেই করে নাচি। আমার বন্ধু জেফ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমরা যীশুর জন্মদিনের আগের দিন নাচো কেন?”
কী বলি!
পার্ক স্ট্রীটের ক্রিসমাস ইভে রাস্তার জনস্রোতের এক ইউটিউব ভিডিও দেখে আমার আর এক বন্ধু ডেভ্ বলে, “এ কী! ওই লোকটা সেটানের শিং পড়ে আছে কেনো ?”
ক্যানাডায় পা রেখেই আমি প্রথম ধাক্কা খাই। পরিচয়পত্র বানাতে গিয়ে এক মেমসাহেব আমার বাবার নাম জানতে চাইলেন। “রবীন্দ্রনাথ দত্ত,” আমি সগৌরবে, এক গাল হেসে বললাম। “ইউ নো রবীন্দ্রনাথ টেগোর? আমার বাবার ওই একই নাম।”
ভদ্রমহিলা স্মিত হাসলেন। “ও কে ... বানানটা একটু বলবেন?”
বুকে বড় বাজে যে সাধারণ বিদেশিরা টেগোরকে চেনেনা, এ কথা জানলে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে তারা টেগোরকে তো চেনেই না, ইন্ডিয়ান বললে ‘বিন্দি ইন্ডিয়ান’, না ‘রেড ইন্ডিয়ান’ সেটা নিয়েই খুব বিভ্রান্ত। তবে ভীষণ জানতে চায়। বিদ্যে তো বড়জোর ক্লাস টুয়েলভ, সিলেবাসে ক্যানাডার বাইরে যে জগত আছে তাই লেখা নেই। কী করে জানবে? আমার এক বন্ধুর মা তার আশি-বছর জীবনে প্রথমবার গুগ্ল ম্যাপে ইংল্যান্ডের গৎ দেখে তো অবাক! “এতো ছোট্টো দেশ, দুনিয়া জুড়ে তার এতো দাপট?” ইংল্যান্ডের ব্যাপারে কিছুটা জানতেই হয়, কেননা ক্যানাডার মতন বৃহৎ দেশও এখনো রানীর অধীনে। তবে অতলান্তিকের ওপারে আর কী আছে বিশেষ কিছু জানেনা। তাই শিখতে চায় সকলের কাছে। আর আমার ঘাড়ে পড়েছে ওনাদের হিন্দুত্ব শেখানোর দায়িত্ব।
যাগ্গে! মুন্নাভাই এম.বি.বি.এস. এর ‘সার্কিটে’র মতন, “গাঁওওয়ালো কো ঘন্টা মালুম হায়”, বলে আমিও কিছু বানিয়ে চালিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমায় যেন কে ভারতের প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছে, সেই গুগ্ল ওলট-পালোট করতে লেগে পড়ি।
সাহেবদের আমরা যতটা উঁচু নজরে দেখি, সাহেবরাও আমাদের সেরকমই উঁচু নজরে দেখে। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কটা ভাষা বলতে পারো?” আসলে তারা তো শুধু ইংরেজি জানে, তাও আবার মাতৃভাষা বলে অনেকে শুধু বলতে পারে, ভাল করে লিখতে-পড়তেও পারেনা। বেশি শব্দও জানেনা। ফাঁকে ফাঁকে ‘লাইক’ আর ‘ইউ নো’ বসিয়ে সব কথা বলে ফেলে। তাই আমরা অন্তত তিনটে ভাষা জানি, আর কেউ কেউ ছ’টা অবধি ভাষা সাবলীল ভাবে জানে শুনলে চোখ কপালে তোলে! আমাকে প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করতো, “তুমি এতো ভালো ইংরেজি শিখলে কোথা থেকে?” আমি বললাম- “আমাদের ২০০ বছর ধরে ট্রেনিং হয়েছিলো গো!”
আর প্রসঙ্গত, সাহেব মানেই যে ইংরেজি বলতে পারবেন, তাও ঠিক নয়। প্রচুর ইস্ট-ইউরোপিয়ান আছেন যাঁরা শুধু পোলিশ, পর্তুগীজ, সার্বিয়ান, বা ইতালিয়ান ভাষাতেই সড়গড়। তাদের ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ইংরেজি শুনলে কলকাতার ‘ইংলিশ-স্পিকিং’ পাড়ার অহংকারে ধস নেমে আসবে।
তবে আমার বন্ধুরা এখন বেশ হিন্দু-শিক্ষিত। কৃষ্ণকে চেনে, দূর্গাকে চেনে, শিবের বেশি হাত-পা নেই, তাই তার শক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল একজন। ত্রিনয়ন খুললে বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে বলাতে চুপ করে গেছিল।
কিন্তু, অবাক কাণ্ড! কৃষ্ণ এখানেও তাঁর সন্মোহনী জাল ফেলে দিয়েছেন। ভগবৎ গীতা আমরা পড়িনি, কিন্তু এনারা পড়ে ফেলেছেন। এবং কোথায় যেন এখনও কৃষ্ণের কূটনীতি সর্বকালীন, সর্বধর্মে, সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ইসলাম এবং খ্রীষ্টধর্ম দুটোই গোঁড়া লাগে বলে দলে দলে সাহেব শ্রীকৃষ্ণের হাত ধরে হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করছে। কিন্তু তারা গীতা মুখস্থ করে, করছে, বুঝে করছে। তাই ‘ভক্ত্’রা যদি ভেবে থাকেন এনাদের মার্কেটিং টার্গেট করবেন, তাহলে ভালো করে গীতা পড়ুন, কৃষ্ণকে জানুন, পূরাণ পড়ুন... একজন্ম পরে এসে যোগাযোগ করুন বরং।