Advertisment

প্রবাসিনীর চিঠি: ক্যানাডায় ক্রিসমাস বারণ

আমি তখন বিমানের সামনের ফাঁকা দিকটায় এগিয়ে গিয়ে সটান হয়ে যোগাসন করতে শুরু করে দিলাম। আমারও পুজো করার অধিকার আছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

কানাডার তুষারশুভ্র বড়দিন

টরোন্টোতে আসার পর আমি একটা দারুন শব্দ শিখেছি, ‘হালাল’।  তার আগে ৪২ বছর ভারতে থাকতে কোনদিন শুনিনি। কে জানে, হয়তো কানই দিইনি । ‘হালাল’ আর ‘ঝটকা’। মাংস কাটার বৈশিষ্ট্যের ওপর মানুষের বিচার হয়। কে কতটা, কিভাবে, জন্তুটাকে কষ্ট দিয়ে মারছে, তার ওপর ভর দিয়ে চলে ক্যানাডার অলিখিত কিছু আইন। ধর্ম-উদারতা প্রমাণ করার জন্য সমস্ত ‘রিটেল জায়ান্ট’, যথা ওয়ালমার্ট, ফ্রেস্কো, নো-ফ্রিল্‌স্‌, লঙ্গওস, লবলস্‌ ইত্যাদি সবাই ক্রমশ ‘হালাল’ মাংসই রাখছে।

Advertisment

আর ক্রিশ্চানরা কোণঠাসা । তাদের ক্রিসমাস পালন করায় নানান বাধা। বাদামি মানুষ থিক-থিক করছে, আর সাহেবরা দলে দলে আরো ঠান্ডা, উত্তর ক্যানাডার দিকে পাড়ি দিচ্ছে । আমার খারাপ লাগে। বহুসংস্কৃতির উদারতা দেখাতে গিয়ে দেশ যথারীতি অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের তাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু থেকে কিছুটা বঞ্চিত করছে দেখে।

আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: টরন্টোর রাস্তায় ঢাক, কাঁসর, কাশফুল

দেশে থাকতে কতো কি ভাবতাম! না জানি বিদেশে ক্রিসমাসে কি দারুন উৎসব হচ্ছে! নিউ মার্কেট থেকে দাদু পুঁচকি একটা ক্রিসমাস ট্রি এনে দিতেন আর আমি তুলো দিয়ে সেটা সাজাতাম। বড়ো হয়ে বিদেশি সিনেমায় দেখতাম রাস্তায় বিশাল বড়ো বড়ো ফার্ণ গাছে সত্যিকারের বরফ পরে আছে। বিস্বয় চোখে দেখতাম! কি হিংসেই হতো! ভাবতাম যদি সত্যিকারের বরফ পাই তো কি মজাই না হবে! কোনদিন ভাবিনি সেই বরফের দেশেই থাকতে হবে বাকি জীবন।

কিন্তু সত্যি কি তাই? প্রায় দশ বছর ক্যানাডায় আছি। ফ্যাটফ্যাটে সাদা প্রকৃতির বুকে আলো দিয়ে সাজানো ফার্ণ গাছের ওপর বরফ পরে থাকতে দেখতে এবং তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে পেরে সত্যিই প্রাণটা ভরে যায় আজও। কিন্তু কাউকে “মেরি ক্রিসমাস” বলতে পারিনা। মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলতে হয়, “হ্যাপি হলিডেস!” কেননা, অনেক অলিখিত নিয়মের সঙ্গে, এই আপাতদৃষ্টিতে বহু-সংস্কৃতির, ‘বহুধর্ম-ইনক্লুসিভ’, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে, অন্যান্য উৎসবের সাথে ক্রিসমাসেরও গণ-উদযাপন করায় অনেক বাধা।

স্কুলে স্কুলে, বিভিন্ন সংস্থায়, ক্রিসমাস ট্রি লাগানোর নিয়ম ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখানকার মুসলিমরা বলে, ক্রিসমাস উদযাপন মুসলমানদের জন্য 'হারাম'। অতএব, সান্তা ক্লজ থেকে উপহার আশা করাটা শিশুদের অপরাধ, শীতকালীন আনন্দ উদযাপন এবং বড়ো বড়ো গাছকে সাজিয়ে রাখা অবশ্যই একটি পাপ, যা তাদেরকে 'জাহান্নামে' পাঠাবে। আর যেহেতু এখানকার সরকারও বাকি অন্য দেশের সরকারের মতন মুসলিমদের সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবে, তাদের মতামত প্রথমেই ধার্য্য। সুতরাং, যা পালন করবে, নিজের বাড়িতে করো, চার্চে করো, রাস্তায় নয়, প্রকাশ্যে নয় । ‘সব ধর্মের’ কথা চিন্তা করো।

নিঃসন্দেহে, হিন্দু ধর্ম, তথা, ক্রিসমাস-পাগল বাঙ্গালীদের কথা কেউ অতো ভাবেনা। তারা শুধু সংখ্যালঘুই নয়, তারা হাতে গোণা।

কিন্তু ইসলাম ধর্মের নামাজ পড়ার জন্যও প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একটা ‘পুজো ঘর’ থাকতে হবে। সেখানে অবশ্য যে কেউ যেতে পারে, কিন্তু, কোন হিন্দুকে, বিশেষ করে কোন বাঙ্গালীকে প্রহরে প্রহরে পুজো করতে দেখেছেন?

publive-image কানাডার ক্রিসমাস

এবার কলকাতা থেকে ফেরার সময় এক মজার ঘটনা হল। ৩০ ঘন্টা প্লেনে বসে থাকার পর গা-হাত-পা আড়ষ্ট। এক বিমানসেবককে হাত নেড়ে ডাকলাম, “এক্সক্যুজ মি! আমি কোথায় পুজো করতে পারি বলতে পারেন?”

“অ্যাঁ! আপনি কোন ধর্মের?” সে থতমত খেয়ে বলল।

“হিন্দু”

“ও, আচ্ছা... যে কোন জায়গায় করতে পারেন।” হিন্দু ধর্মের কেউ তো প্লেনে পুজো করেনি আগে, তাই সে অবাক! কিন্তু অন্য ধর্মের লোকে করে।

আমি তখন বিমানের সামনের ফাঁকা দিকটায় এগিয়ে গিয়ে সটান হয়ে যোগাসন করতে শুরু করে দিলাম। আমারও পুজো করার অধিকার আছে।

অতএব, ক্যানাডায় সাহেবরা এবং হিন্দুরা কোণঠাসা। ক্রিসমাসে ক্রিশ্চানরা নিজের নিজের বাড়িতে ট্রি লাগায়, ক্যারোল গায়, নিজেদের মধ্যে উদযাপন করে। আমি তো প্রথমবার দেখে অবাক! এসেছি কলকাতা থেকে, বড়দিনে নিজামের কেক- খাওয়া, ট্র্যাকে চেপে হূল্লোড়-করে পিকনিকে যাওয়া, পার্ক স্ট্রিট মাতাল করা শহর থেকে। এখানে এসে দেখি সব খাবারের দোকান বন্ধ! কেক কিনবো কেকের দেশে, একটাও দোকান খোলা নেই। ওদিন নাকি সবার ছুটি, রেস্তোরাও। যাঃ বাবা! মিসিসাগার মতোন বড় শহরের রাস্তা-ঘাট খাঁ-খাঁ করছে । চারিদিকে বরফ বটে, আর আলো দিয়েও কিছু গাছ সাজানো বটে, কিন্তু একটাও মানুষ নেই! কি শুনশান! শুধু বোঁ-বোঁ করে গাড়ি যাচ্ছে।

কি করি? বাড়িতেও খাবার রাঁধিনি বাইরে খেতে যাবো বলে। ঠান্ডায়, দুঃখে, হতাশায় এদিক সেদিক ঘুরে, এক লেবানিজ দোকান থেকে একটা ম্যারম্যারে, শুকনো কেক কিনে বাড়ির সামনে এসে দেখি এক ম্যাকডোনাল্ড খোলা। বলা বাহুল্য, ম্যাকডোনাল্ড কিন্তু এখানকার ‘চায়ের দোকান’, মোড়ে-মোড়ে আছে। বিশেষ পাতে ফেলেনা কেউ। তাতেই ঢুকে অতি বিস্বাদ বার্গার চিবিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেদিন নমস্কার করেছিলাম। আর কোনদিন কাউকে, কোনকিছুকে হিংসে করবনা। এই নাকি বিদেশের ক্রিসমাস?

স্বভাবতই, আমরা বাঙ্গালীদের বাড়িতে বড়ো বড়ো ক্রিসমাস ট্রি দেখে তো সাহেবরা আহ্লাদে আটখানা! “তোমরাও ক্রিসমাস পালন করো?!!”

কি কান্ড!

ওরে! শুধু পালন-ই করিনা, ভারতে তো ভুলেই যাই কোনটা কার পালন করার কথা। এইতো এ বছর কলকাতার গলিতে গলিতে গণেশপুজো! বড়বাজার ছাড়া কোনদিন কোথাও গণেশপুজো হতে দেখেছি? তাও আবার প্যান্ডেল করে?

আমার এক বন্ধু ফেসবুকে লিখল, “মাঝখান থেকে বিশ্বকর্মার বাজারটা গেল!” সত্যি, ঘুড়ি তো আর কেউ ওড়ায়না। নাকি মকর সংক্রান্তিতে কারা যেনো ওড়ায়। ‘রঈস’ সিনেমাতে দেখেছিলাম। ঈদে বিরিয়ানি, পীর-বাবার ঝাড়-ফুঁক, দর্গায় চাদর, গুরদ্বারায় ফ্রি-মিল, ক্রিসমাসে সেন্ট্‌ পল্‌স্‌ ক্যাথিড্রালে মোমবাতি, ক্রিসমাস-ইভে পার্ক-স্ট্রিটে নাচানাচি, ভারতীয়দের মধ্যে কার যে কোনটা পালন করার কথা আর কে কে যে পালন করে তা এখন টোটাল ঘেঁটে ঘ! এখন সব বিয়েতেই গায়ে হলুদ, সব বিয়েতেই মেহেন্দি, সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র। সব নিয়ম লাটে। সবাই সিঁদুর খেলে। এখন তো মনে করতে হয় পুজোয় সিঁদুর খেলার সময় কে মুসলিম ছিল, কে ক্রিশ্চান আর কে হিন্দু। এমনকি, অনেক পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়লে ভাবতে হয়, আরে! মুনিরা তো মুসলিম ছিল! জ্যোতি ভারগীস তো ক্রিশ্চান! ভারতের বাইরে পা না রাখলেও বোঝা যায় যে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষটা অসভ্যভাবে রক্তে মেশা, সহস্র রাজনৈতিক ঝটকাও তাকে ভাঙ্গতে পারছেনা। আর ক্যানাডার মত “উন্নত” দেশের সবে মাত্র অন্য ধর্মের সাথে পরিচয় হচ্ছে।

এখানে তো প্রথম আলাপেই পদবি জিগ্যেস করে। তাতেই কে কোন দলে, তাকে মনে মনে সে দলে ফেলে দেয়। তারপর ধর্মনিরপেক্ষতার উদারতা দেখায়। কিন্তু নিজের ধর্মের না হলে বেশির ভাগই বাড়িতে ডাকেনা। মেশেইনা। আর কারোর বাড়িতে যায়ওনা। কেন? হালাল মাংস ছাড়া খাবেনা। ওই যে বললাম, মাংস কাটার বৈশিষ্ট্যের ওপর কে বন্ধু তা বিচার হয়, কার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো উচিত না উচিত নয়, সেটা ভাবা হয়।

সে’তো আমাদের ঠাকুমা’রা করতো! তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষার পাট ছিলনা। ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল। বাতিক ছিল। কার বাড়িতে কিসের ছোঁয়া, বাবা! যাবেনা, খাবেনা। এখন তো একবিংশ শতাব্দী! মার্সেও কি হালাল মাংস যাবে নাকি? চাঁদে কি বিফ যাবে কিনা তা নিয়ে গোলযোগ হবে?

মুসলিমরা গরমকালে এখানে গোড়ালি অবধি একটা খাটো পাজামা পরে। সেটা যে ওনাদের ধর্মীয় পোশাক তা আমার কোন মুলসিম বন্ধুর কাছে আগে শুনিনি। আর মহিলারা তো বোরখা পরা, বেশীরভাগই হিজাব। ধর্ম নিয়ে বৈষম্য ভাই ভারতে ৪২ বছর থাকতে দেখিনি।

আমি বলি কি, ভারতে আজ এতো ডামাডোলের মধ্যেও সাধারণ মানুষ যেভাবে সর্বধর্ম-সংমিশ্রণে একে-অপরের ধর্ম নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে আছে, সেটা অন্য সব দেশের দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। বিশ্বের শুধু কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ জানেন ভারত কতটা আদর্শ মডেল। আর ছেলেমানুষ ভারতবাসী জানলোইনা যে বিশ্ব-দুয়ারে তারা কি বিরাট একটা উদাহরণ।

Advertisment