১৬.৮ X ৭ ইঞ্চি সীটের মাপ। আর আমার কোমরের বেড় সাড়ে ৪৪ ইঞ্চি । “দুইয়ে মিশ খাবে কি করে?”
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে চড়ে সিটের দিকে তাকিয়েই আমার গব্বর সিং-এর সেই কথাটা মনে পড়ল, “উও সর্, ইয়ে পেয়র্...” এবার ‘সর্’ আর ‘পেয়র্’ ফিট্ করনোতেই চলল পরবর্তী ২৭ ঘন্টা।
নিশ্চই এঁটে যাবো, এই ভেবে নিজেকে সিটে গুঁজে দিলাম। বেল্ট বেঁধে বিমান ওড়ার পর উঠতে গিয়েই বুঝতে পারলাম কী খপ্পরেই না পড়েছি। পাশের ভদ্রলোকের সাহায্য নিতে হল সিট থেকে বেরোতে। তারপর থেকে অনেকটা রাস্তাই আমি দাঁড়িয়ে, যেনো ভিড় বাস। সিট নেই। যেনো কারোর জন্যও অপেক্ষা করছি এরকম ভাব। কিছুক্ষণ বাদে বাথরুমের সামনে এগিয়ে গেলাম, যেনো কেউ বেরোলেই আমি যাবো। খানিক যোগাসনও করে নিলাম। ভাবতে লাগলাম, এরকম কি কোনো সূচনা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে যেখানে লেখা ছিল, “ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ চড়তে গেলে কোমরের মাপ এতো ইঞ্চি হওয়া উচিত।” অথবা, “ঠ্যাঙের দৈর্ঘ্য এতো ইঞ্চি হওয়া উচিত”, কেননা আমার পিছনের লম্বা ভদ্রলোক তার পা’দুটোকে কোথায় রাখবেন বুঝতেই পারছিলেননা। একবার আইলের দিকে ছড়িয়ে দিলেন, একবার উঠে দাঁড়ালেন, একবার হাঁটু গুঁজে পিছনের দিকে পা মোড়ার চেষ্টা করলেন, সে এক কাতর দৃশ্য।
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: ক্যানাডায় ক্রিসমাস বারণ
আমি তো একবার ব্যাগটা ফেলে দিয়ে, “এই যাঃ!” বলে মাটিতে হামা দিয়ে থ্যাপন গেড়ে বসে পড়লাম জিনিসপত্র গোছানোর ছুতো করে। অন্তত, কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে বসা গেল।
কিন্তু আর কতক্ষন ধোঁকা দেওয়া যায়? পরের ২৫ ঘন্টা ওই খোঁয়াড়েই নিজেকে বাঁধতে হল। একেই বলে “ইকনোমি ক্লাসের সিট”। দাম প্রায় ৭৫,০০০-৮০,০০০ টাকা। কলকাতায় সাইকেল রিক্সার সিট এর থেকে অনেক বড়। অনেক সম্মান সেখানে। মাত্র ২০ টাকায়।
অসম্মানিত, অপমানিত, মায় হালালের মুর্গির মতোন ঝুড়িতে বাঁধা এক পাল মানুষকে “অত্যন্ত যত্ন-সহকারে” উড়িয়ে নিয়ে এলো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। এত “যত্ন”, যে বেল টিপে তেনাদের ডেকে জল চাইলেও তেনারা বিরক্ত। ব্রিটিশদের আজকাল আমি আর আন্তর্জাতিক অপরাধী হিসেবে দেখিনা। তারা অজ্ঞ, নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই জানেনা। তাদের পিতামহ-প্রপিতামহরা যে কত দেশে কত খুন করেছে, কত অত্যাচার করেছে, তা তেনারা কিছুই জানেনা। তাই এখনকার আক্ষরিক-অর্থে কানে কুলুপ দেওয়া প্রজন্মকে দোষ দেওয়াটাই বেকার। এখনকার ব্রিটিশদের আমি বলি ‘পেট্ পীভ্স্”। গাঁয়ে-মানেনা-আপনি-মোড়ল ভাব এখনো। চলায়, ফেরায় ধরণী কাঁপে, সারা পৃথিবীর মানুষের প্রতি অবজ্ঞা। আগেকার দিনের রাস্তার বাংলা-মিডিয়ামে পড়া ছেলেরা যে চোখে পাড়ার ইংরেজি-মিডিয়ামের মেয়েদের দেখতো, আমি আজকাল সেরকম চোখে ওদের দেখি।
সেইজন্য যেই অতলান্তিক পেরিয়ে আমার অত্যন্ত “পেট্ পীভ্” শহর লন্ডনে নামলাম, অমনি ঠিক করে ফেললাম পরের বার কলকাতায় আসবো ট্রেনে করে।
আমার সঙ্গে একমত হবে জানি অনেকেই, যাদের ধম্ম-কম্ম বছরে একবার কলকাতা যাওয়া। তাঁরা হাসবেন না। বলবেন না “পাগলের প্রলাপ”। তাঁরা বুঝবেন যে আমি মজা করছি না।
সত্যি যাওয়া যায় ট্রেনে করে ! মাত্র ১৬-১৭ দিন লাগে, আর খরচা লাগে আনুমানিক $১৫০০।
তিনটে পথ আছে। একটা লন্ডন থেকে প্যারিস হয়ে ইউরেলে ইস্তানবুল (ROUTE 1)। লন্ডন থেকে প্যারিস যেতে লাগবে দু থেকে আড়াই ঘন্টা। টিকিট, ৩৩ পাউন্ড। সেখান থেকে ইস্তানবুল এক্সপ্রেসে প্রথমে জুরিখ, ৫ ঘন্টা মতন, ২০০ পাউন্ড। জুরিখ থেকে জাগ্রেব (ক্রোশিয়া, দ্বিতীয় দিন) রাতের ট্রেন, বেশ ভালো ফার্স্ট ক্লাস কুপ। আগের থেকে কোন দেশে কিরকম তাপমাত্রা জেনে গেলে ভালো হয়। আর তা ছাড়া, তল্পিতল্পা হালকা নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
সকালে পৌঁছয় জাগ্রেব। জাগ্রেব থেকে বেল্গ্রেড কনেক্টিং ট্রেন। বেল্গ্রেডে সন্ধ্যায় পৌঁছয় ট্রেনটা।
হোটেল মোস্কভা-তে কফি খেয়ে জেল্টুরিস্ট স্টেশনে নৈশভোজ করে সোফিয়া, বুলগারিয়ার উদ্দেশে রাতের ট্রেন (তৃতীয় দিন) এই ট্রেনটার কুপগুলো একটু ছোট, তবে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ইকনমি ক্লাসের কথা ভেবে নিলেই নিমেষে হাত-পা মেলে শুয়ে পড়বেন। বাইরে আঁধার। ছুটে চলেছে ট্রেন অদেখা প্রান্তর দিয়ে।
ভোরে সোফিয়ায় অবতরণ। নৈসর্গিক দৃশ্য !
চতুর্থ দিন! বুলগেরিয়া । সোফিয়ার মতন সুন্দর নামের সুন্দর শহরে দিনটা কাটিয়ে রাতের ট্রেনে বলকান এক্সপ্রেসে করে ভোরে ইস্তানবুল, টার্কি। এটা একটা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা।
এবার একটু ধৈর্য্য়ের খেলা, কেননা ইস্তানবুল থেকে ইরানের তেহরান তিন দিন। আর তেহরান থেকে কোনো ট্রেন নেই পাকিস্তান হয়ে ভারতে পৌঁছনোর । আগে নাকি ছিল। তারপর বোমা-টোমা পড়াতে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। একটা গাড়ির রাস্তা আছে করাচি অবধি ২৫০০ কিলোমিটারের মতন, মাক্রাল কোস্টাল হাইওয়ে। সেটা ধরে করাচি পৌঁছে যেতে পারলে, তো ব্যাস! বাড়ি! আবার কী? একটু পাকিস্তানের সাথে ভিসা নিয়ে বচসা হতে পারে, যেমন হয় আর কি। সেগুলো আগের থেকে মিটিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো।
এরপর করাচি থেকে লাহোর, লাহোর থেকে দিল্লি “সমঝোতা এক্সপ্রেসে”। দিল্লি পৌঁছে অবশ্য কলকাতা যাওয়ার ট্রেনে ১৫-১৬ ঘন্টা বিলম্ব হতেই পারে। কিন্তু, তাতে কি? ১২টা দেশ পেরিয়ে এলেন, ১২টা দেশের বিভিন্ন রূপ, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন সংস্কৃতি, প্রাদেশ, আবহাওয়া, সন্ত্রাসবাদীদের হামলার আতঙ্ক, সব কিছু জীবন খাতার প্রতি পাতায় লেখা হল। আকাশ দিয়ে উড়ে এলে এই মজাটা পাওয়া যেতো? এতো কিছু দেখতে দেখতে হাত-পা ছড়িয়ে স্বাধীন ভাবে বেড়ানো যেতো? স্বাধীন ভাবে চলা ফেরা করতে পারা। একটু হাঁটতে পারা। যাদের প্লেনে ওড়ার ফোবিয়া আছে, তাদের পক্ষে তো এর থেকে সুখবর আর কিছুই নেই। আরো একটা সুখবর দি, ক্যানেডিয়ান বা আমেরিক্যান পাসপোর্ট যাদের আছে, তাদের ইউরোপের কোন দেশের জন্যই ভিসা লাগবেনা।
আর একটা জব্বর পথ আছে লন্ডন থেকে বার্লিন হয়ে ইউরোস্টারে করে মস্কো, (ROUTE 2)। ১ দিন ১৬ ঘন্টা। মাত্র ৩০০০ রুবেল, বা ৬০ ক্যানাডিয়ান ডলার। তারপর মস্কো থেকে ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রেলে উলান উডে, উলানবাটোর হয়ে, বিজিং। সেটার সময় সাত দিন ধরে নিন। বিজিং থেকে ৪০ ঘন্টা লাগে লাসা। লাসা থেকে ৭ ঘন্টা বাসে পৌছনো যায় ইয়াদং জিয়ান, ভুটানে। ব্যাস! ভুটান থেকে শিলিগুড়ি জংশন, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা!!! আর পুজো!
ইউরেকা! শুধু অতলান্তিক পেরোতে হবে প্লেনে, তারপর আর দেখে কে!
অবশ্য, যারা অতলান্টিকও প্লেনে করে পেরোতে চান না, তাঁদের জন্যও আর একটা রাস্তা আছে। (IMPOSSIBLE ROUTE)। তবে সে রাস্তা দিয়ে পেঙ্গুইনও যেতে ভয় পায়। সেটা হল বেরিং স্ট্রেট দিয়ে।
বেরিং স্ট্রেট কোথায়? ম্যাপ দেখো। বেরিং স্ট্রেট হল রাশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে সেইটুকুন ফাঁক, যেখানে হাত মিলতে গিয়েও মেলেনা। কিন্তু মিলতো। এক সময় মিলতো। আইস এজের সময় মিলতো। সেইজন্যই তো ১৪০০০ বছর আগে সাইবেরিয়া থেকে বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ বা বেরিঙ্গিয়া দিয়ে আমেরিকায় হেঁটে হেঁটে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। এখন ওইখানে বরফ গলে গিয়ে ৫৫ কিলোমিটার ফাঁক। এবং সেই ফাঁক দিয়ে অনেক বিতর্কই গলে যাচ্ছে। যাক্গে, সেসব কথা আর একদিন হবে।
কিন্তু সেখানে কোনো রাস্তা নেই। শুধু বরফের চাঙড়। চরম গরমেও তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠেনা । আর শীতকালে মাইনাস ১০০ ডিগ্রি অবধি নেমে যায়। কারো পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব নয় সেই সময়ে।
তাই বলে অতো ভয় পেলে চলবে নাকি? তাহলে দম আটকে যাও বরং প্লেনে চেপে ২৭ ঘন্টা ধরে!
ভিয়া রেল করে টরন্টো থেকে ভ্যাঙ্কুভার চলে যাও, তারপর বাস, নৌকো নিয়ে অ্যাঙ্কোরেজ, আলাস্কায় পৌঁছে যেতে হবে। অ্যাঙ্কোরেজ থেকে ওয়েলস যেতে হবে বাসে। সেখান থেকে রাশিয়ার ভিসা বাগিয়ে, একটা ছোট্ট ফ্লাইটে টুক করে লাভ্রেন্টিয়া বা চুকটকায় পৌঁছতে পারা যায় ঠিকই, তবে সেখান থেকে বিজিং যেতে মা দুগ্গাই ভরসা কেনোনা, সেখান থেকে গাড়ি চলার পথ পর্যন্ত নেই। কিছু উট আছে... আর ছাগল।
আমার মনে হয় রাশিয়ার ভিসা বাগাতে পারলে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলে আর ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রেলে চেপে পুজোয় কলকাতা যাওয়াটা একটা বিস্ময়কর, চাঞ্চল্যকর এবং স্মরণীয় ঘটনা শুধু হবেনা, একটা নতুন ধরনের স্বাধীনতা আন্দোলন হবে। মুর্গি-চালানকারী বিমান পরিবহণব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন। রুট, লন্ডন-মস্কো-ঊলানবাটোর-বেজিং-লাসা-ভুটান-শিলিগুড়ি-কলকাতা। সময়ঃ ১৬-১৭ দিন। ইতিহাস তোমাকে মনে রাখবে। আমি তো তাই যাব ঠিক করেছি।
শেষে সব শুনে আমার কর্তা জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা বেশ। তাহলে ফিরে আসার সময় তোমাকে কি এয়ারপোর্টে তুলতে যাবো না স্টেশনে?”