(দীর্ঘদীনের কানাডা প্রবাসী কাবেরী দত্ত চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সে দেশে নিষ্কৃতিমৃত্যু নিয়ে সম্প্রতি যে হইচই শুরু হয়েছে, তার কথা। লেখায় প্রকাশিত মতামত তাঁর ব্যক্তিগত।)
ভীষ্ম-কাল এসে গেলো নাকি!
মহাভারতের যত কাণ্ড-কাহিনি - তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল কিনা, বা তা সত্যি-সত্যি প্রযুক্তির শীর্ষে পৌঁছনোর কাহিনি ছিল, না কি সবটাই মানুষের কল্পনা, তা জানিনা। কিন্তু ধীরে ধীরে মানবজাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে সেই সব কল্পনার শিখর ছুঁতে চলেছে, এটা মনে হচ্ছে। ইচ্ছামৃত্যুতে কানাডায় গত তিন বছরে প্রায় ৪০০০ মানুষ হত হয়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তার ও নার্স তাদের ‘খুন’ করতে বাধ্য হয়েছেন!
ভীষ্মই বোধহয় আমাদের প্রথম এবং শেষ পরিচিতি ইচ্ছামৃত্যুর সাথে। মহাভারতে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুর বরে অর্জুনের শত-বাণে জর্জরিত হয়েও শরশয্যায় বেঁচে ছিলেন কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি। এরপর যুধিষ্ঠিরকে প্রচুর উপদেশ দিয়ে, ৫৮ রাত্রির পর, এক সু’দিন দেখে দেহত্যাগ করেন। সে প্রায় ৫০০০ বছর আগেকার ঘটনা, যদিও আদৌ তা ঘটেছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ।
কিন্তু আজকের যুগে, ক্যানাডার মতন দেশে ইচ্ছামৃত্যু ২০১৬ সালে বৈধ হওয়ার পর এটা অত্যন্ত আশ্চর্য এবং গভীর দুঃখের বিষয় যে এতো মানুষ জীবন-অপেক্ষা মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে। তিন বছরে ৩৭১৪ ‘খুন’! যদিও তাঁদের সাহসকে কুর্ণিশ করি, তথাপি মন ভার হয়ে যায় ভাবলে যে এত মানুষের শারীরিক যন্ত্রণা এতই প্রবল ছিল এবং বেঁচে থাকাটা তাঁদের কাছে এতটাই যন্ত্রণাদায়ক ছিল, যে কোনও চিকিৎসা বিজ্ঞানই তাঁদের কোন আশা-ভরসা দিতে পারেনি!
আমরা হৃতিক রোশনের একটা সিনেমায় দেখেছিলাম ইচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গ। ‘গুজারিশ’। সঞ্জয় লীলা বনসালীর নির্দেশনা, ২০১০। সিনেমাটা হিট করেনি। কিন্তু প্রসঙ্গটা আজ প্রযোজ্য। ভারতে ইচ্ছামৃত্যু এখনো আক্ষরিকভাবে বাস্তবায়ন না করা হলেও, বহুদিন যাবৎ ভেন্টিলেটর প্রত্যাহারের চল আছে। ২০১৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রোগীদের ভেন্টিলেটর প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্যাসিভ ইউথেনেসিয়া বৈধকরণ করেন। তবে সে ক্ষেত্রে রোগী ‘ব্রেন ডেড’ অথবা ‘পার্সিসটেন্ট ভেজিটেটিভ’ অবস্থানে হতে হবে এবং সবচেয়ে কাছের আত্মীয় তাতে রাজী থাকতে হবে। ‘অ্যাকটিভ ইউথেনেসিয়া’ বা একটি ‘লিদাল’ ইঞ্জেকশনের দ্বারা ‘হত্যা’ এখনো ভারতে অবৈধ, যেটা ক্যানাডায় এখন বৈধ!
মানুষ হওয়ার মর্যাদা যেরকম বেঁচে থাকতে দেয় ক্যানাডা, মৃত্যুর সাথেও সেই মর্যাদা আশা করে ক্যানাডিয়ানরা। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মোটামুটি মানুষেরই প্রবল চাপেই সৃষ্টি হল। মানুষের বক্তব্য প্রত্যেকেরই তাদের মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত। অর্থাৎ, ইচ্ছামৃত্যু। আইন কিন্তু কয়েকটা শর্ত রাখলো। এই ইচ্ছায় ক্যানাডিয়ানরা সদিচ্ছায় মৃত্যবরণ করতে পারেন, তখনই যখন তাদের রোগটা চিকিৎসার অসাধ্য এবং তাঁর মৃত্যুটা অবশ্যম্ভাবী। আরো অনেকগুলো শর্ত দিয়ে মোটামুটি আইনটিকে বেঁধে দিয়েছে সরকার, যাতে কেউ এটার অপব্যাবহার না করতে পারে।
এই প্রসঙ্গ নিয়ে ক্যানাডায় ঝড় উঠেছে। কিন্তু এদিকে তর্কের ঝড় চলছে, আর ওদিকে গত তিন বছরে নিঃশব্দে প্রায় ৪০০০ ক্যানাডিয়ান দেশ জুড়ে ইচ্ছামরণ করে ফেলেছেন। সেটা কি জানে, যারা তর্ক করতে ব্যাস্ত, তারা? ব্যাপারটা এমনই যে এখন আর মানুষ কোনরকম যন্ত্রণাদায়ক অসুস্থতা সহ্য করতে চাইছেনা। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করাটা মৌলিকভাবে মানবিকতার প্রতি অত্যন্ত নির্দয়তা। কিন্তু সেটাই মানুষ সহ্য করে এসেছেন অনন্তকাল থেকে। বিছানায় পড়ে থেকে দিনের পর দিন মৃত্যর জন্য অপেক্ষা করেছেন। “মরণ হয় না আমার,” “কবে ঈশ্বর তুলবেন,” এরকম নানান রকম হাহুতাশ ঘরে ঘরে ছিল। তার প্রিয়জনরা তিতিবিরক্ত হয়েছে, জলের মতোন টাকা খরচা হয়েছে, বেড-সোর হয়ে, আয়ার হাতে, শেষে হেলায়-ফেলায় মারা গেছেন মানুষ। এটাই মানুষের ইতিহাস। তার অন্যথা যে হতে পারে, তা কেউ ভাবেইনি। মানুষ হিসেবে কোন মর্যাদাই আশা করেন না মানুষ। এটাই সবথেকে অবাক করে।
একটা কথা আছে, “মানুষ একা বাঁচতে পারে, কিন্তু একা মরতে পারেনা”। আজ সেই কথাটাই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।
একা মৃত্যুকে বরণ করা মানুষের জন্মগত অধিকার। আমাদের জন্ম আমাদের হাতে নেই, বার্ধক্য আমরা আটকাতে পারিনা, অসুখ হওয়া আমাদের হাতে নেই, অমরত্ব হাতে নেই, কিন্তু মৃত্যুকে তো জয় করাই যায়? অসুখে ভুগে, চরম কষ্ট পেয়ে, মৃত্যু কবে আসবে, সে অপেক্ষা করার চেয়ে, দু’পা এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে আক্ষরিক অর্থে যদি বরণ করা যায় তো ক্ষতি কী? সুইজারল্যান্ডে ইউথ্যানেসিয়া বহুবছর ধরে প্রযোজ্য, সেই ১৯৪২ থেকে, এখন ক্যানাডাও এটি বৈধ করেছে। সুইজারল্যান্ড একমাত্র দেশ যেটি বিদেশিদের ইউথেনেসিয়ার অনুমতি দেয়। ‘সুইসাইড ট্যুরিজম’ বলে একটা চলতি কথা আছে সেখানে, যাতে প্রচুর বিদেশি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন গত কয়েক বছর ধরে, আশ্চর্যজনকভাবে তার মধ্যে ৬০% জার্মান।
ক্যানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রবীন মোরো নামে এক ৬৮-বছর বয়সী মহিলা গত বছর মার্চ মাস থেকে ভুগছিলেন পার্কিন্সন্স্ ডিজিজে । মোরো তীব্র যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন, কিন্তু তার ডাক্তার, এলেন উইবে, তাঁর মৃত্যুর সহায়তার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না, কেননা মোরো ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ নন, অতএব তিনি মৃত্যুর ‘যোগ্য’ (qualified to die) নন! মোরো এই শর্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন কোর্টে। মামলাটি সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের অংশ হয়ে দাঁড়ায়, যা একটি উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়। মানুষ যে মৃত্যুর জন্য "যোগ্য" হতে হবে এমন ধোঁয়াটে আইনের গন্ডিরেখা মুছে দেন জজ পল পেরেল, এবং অবশেষে অন্য আর এক ডাক্তারের সাহায্যে উইবে মোরোকে লিদাল ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তাঁর অমানুষিক কষ্ট থেকে মুক্তি দেন গত বছর অগস্ট মাসে।
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: ত্রাসগ্রস্ত টরন্টো
এতো গেলো একটা উদাহরণ। এরকম অনেক নিদর্শন আছে। সরকার ইউথেনেসিয়া আইনটির প্রয়োগে ধীর পায়ে এগোনোর ফলে এবং ডাক্তারদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার হেতু, কিছু মরিয়া রোগী খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে দেশজুড়ে, যাতে তাদের মৃত্যু দ্রুতগতিতে হয়। অন্যরা আত্মঘাতী এবং প্রায়ই সহিংস প্রক্রিয়ার গোপনে মৃত্যু-বরণ করছে। কিছু রোগী অর্থব্যয় করে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছে মৃত্যুর অভিপ্রায়ে। এক কথায় ক্যানাডিয়ানরা ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে এতটাই বিহ্বল, যে শোনা গেছে সম্প্রতি পূর্ব ক্যানাডায় এক ডাক্তার এক মায়ের কাছে তার মানসিক-ভারসাম্যহীন সন্তানের ইউথেনেসিয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।
এক দিক থেকে দেখতে গেলে, এটা নিশ্চই মানুষের তার প্রাপ্য অধিকার সাব্যস্ত করা হয়, আবার অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে অবাক হতে হয় মানবজাতির নৈতিক মূল্যায়নের পতন দেখে! একজন মা তার শিশুকে পেটের ভিতর ন’মাস বয়ে, কী প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে তাকে জন্ম দেয়। মানুষ করে বছরের পর বছর, হাঁটি-হাঁটি পা-পা, একটা-দুটো করে কথা বলতে শেখানো, অক্ষর শেখানো - একটা ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ করে তোলে। অবিশ্রান্ত খেটে শিশুটির অভিভাবকরা তার বাসস্থান, খাওয়া-দাওয়া যাবতীয় জোগান দেন যতদিন না সে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই সন্তানের মন কি একটুও কাঁদেনা তার মা অথবা বাবার এমন অসহায় অবস্থা দেখে? সবই কি সে ভুলে যায় নিজেদের জীবন-যাপনের তাড়নায়? তাদের কাজ মিটে গেলেই তারা কি মা-বাবার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে? বিকলাঙ্গ শিশুকে মা হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটে?
এ সবই তর্কের বিষয়। কিন্তু যতক্ষন না এই বচসার মীমাংসা হচ্ছে ততক্ষণ আমার মনে হয় যে রোগভুক্ত, তাকেই তার জীবনের অধিকার দেওয়া উচিত। সন্তানের মুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকবেন কি না সেটা তারই সংকল্প হওয়া উচিত। অবশ্য, এ যুগে আর “অন্য আর একজনের জন্যও বেঁচে থাকা” টা ঠিক কারণ হিসেবে মানা যায়না। সে সত্য যুগ আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।
আচ্ছা, ইচ্ছামৃত্যু তো হল, ইচ্ছা-অমরত্ব তবে কত দূর?