(দীর্ঘ দিন ধরে শান্তিপ্রবণ কানাডায় বাস করছেন। সেখানকার মানুষজনকে দেখছেন। সম্প্রতি ঘটা বেশ কয়েকটি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে কি বদলে যাচ্ছে সে দেশ? লিখলেন কাবেরী দত্ত চট্টোপাধ্যায়)
ত্রাস এবার ঘুরে ফিরে এলো পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপ্রিয় দেশ, কানাডায়। “আমেরিকায় হয়,” লোকে বলে। কানাডায় তো হত না? কানাডা পৃথিবীর প্রথম দশটি শান্তিপ্রিয় দেশের মধ্যে পড়ে। এখানে শান্তিতে বসবাস করার ইচ্ছায় চলে আসেন অনেক মানুষ। সেই কানাডা আজ ত্রাসগ্রস্ত। একবার নয়, দু বার নয়, বার বার বিভিন্ন আকার নিয়ে ত্রাস দাপাচ্ছে টরন্টোর মতন মহানগরে। ২০১৮ সালে এই নিয়ে তিনবার হানা দিল - ‘সন্ত্রাসবাদ’ কিনা অবশ্য বলা যাচ্ছেনা।
শুরু হয়েছিল বলা যায় জানুয়ারি ২৯, ২০১৭, কিউবেক মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার খবরে। সেই প্রথমবার কানাডাবাসী কেঁপে উঠেছিলন। এ কী! কানাডার শুভ্র ভূমিতে রক্তের দাগ? অপরাধী, আলেক্সান্ড্রেস বিসননেট, সন্ধ্যার নামাজের সময় মসজিদের ভিতরে ঢুকে গুলি চালায়। ছযজন নিহত হন এবং ১৯ জন আহত হন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং কিউবেকের প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইলার্ড একে সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে অভিহিত করেন, যদিও বিসোনেটেকে ক্রিমিনাল কোডে সন্ত্রাসবিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় নি।
পরের মারাত্মক হামলা হয় এ বছর, এপ্রিল ২৩। সেদিনটা আমার খুব মনে আছে। আট মাসের হাড়-কাঁপুনি ঠান্ডার পর বরফের দিন্গুলি সবে গুটি-গুটি পায়ে বিদায় জানাছে আর রাস্তা-ঘাট একটু একটু করে রঙিন হয়ে উঠছে। এখানে এপ্রিল পর্যন্ত বরফের দাপট থাকে; বসন্তের একটু আধটু গন্ধ পেলেও আমি গাছগুলোকে দেখি – তারা যদি সবুজ বেশ না পরে, তাহলে বোঝা উচিত এখনো আর একবার বরফের ঝাপটা আসবে।
তাই এসেওছিলো। পয়লা বৈশাখের দিন, দিগন্ত সাদা করে এলো বরফঝড়! তার ঠিক পরেই দ্রুত বিদায় জানাচ্ছিলো শীত, আর সকলে -- হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-সাদা-কালো-খয়েরি নির্বিশেষে ওই পোড়াচ্ছাই কালো জ্যাকেটের খোল থেকে উন্মুক্ত হয়ে, রঙিন জামাকাপড় পরে, খোলা চুলে হই-হই করে বেরিয়ে পড়েছিলেন একটু উষ্ণতার খোঁজে।
সেদিনই হুড়মুড়িয়ে এলো ওই ভ্যানটা। অ্যালেক মিনাসিয়ান নামক এক ২৫ বছরের যুবক তাঁর ভাড়া-করা ভ্যান নিয়ে নর্থ-ইয়র্ক সিটি সেন্টারের গায়ে, ইচ্ছাকৃতভাবে পথচারীদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিল, পিষে মারল দশজনকে, এবং গুরুতরভাবে আহত করল ১৬জনকে। ঘটনাটি কানাডিয়ান ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম হামলা। মিনাসিয়ান মানসিক রোগী ছিল, এবং হয়তো নিজেকে ‘ইনসেল’ (অনিচ্ছাকৃত সেলিবেট) ভাবত। ঘটনার একটি সাক্ষী বলেন, চালক আক্রমণের সময় সরাসরি পথচারীদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল এবং যেন "ভিডিও গেম খেলছে, সেভাবেই যতগুলো সম্ভব মানুষ হত্যা করার চেষ্টা করছিল"। এই ঘটনাতেও কোনো সন্ত্রাসবাদের গন্ধ পাওয়া যায়নি। মানসিক-অবসাদগ্রস্ত এক যুবকের কাণ্ড; একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছে।
এরপর ঘটল গ্রীকটাউন হামলা। বাইশে জুলাই, ২০১৮, এক গ্রীষ্মের রাতে টরন্টোর গ্রীকটাউন অঞ্চলে ড্যানফর্থ এভিনিউতে ফয়সাল হোসেন নামক এক ব্যাক্তি এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে দু'জনকে হত্যা করে এবং তাতে ১৩ জনকে আহত হয়। টরন্টো পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের পর আত্মহত্যা করে সে। যদিও আইসিস এই জঘন্য অপরাধের দায়িত্ব নিয়েছে, টরন্টো পুলিশ কিন্তু কোনো সন্ত্রাসগোষ্ঠীর এতে জড়িত থাকার এখনো প্রমাণ পায়নি। হোসেনের পরিবার বলেছে যে হোসেন নাকি “গুরুতরভাবে মানসিক অবসাদগ্রস্ত ছিল এবং তার ছিল বিষণ্ণতা ও মানসিক রোগের সাথে জীবনযাত্রা”।
কানাডা তার ধৈর্য, সহ্য, ভদ্রতা, শ্লীলতার জন্যই প্রসিদ্ধ। পৃথিবীর শেষ শান্তিটুকু যদি কোথাও অবশিষ্ট থাকে, তা হয়তো এখানেই। সারা বিশ্বের নানান ভাষার, নানা সম্প্রদায়ের, নানা দেশের অধিবাসী বিভিন্ন কারণে কানাডায় এসে নিরাপদে তাদের বাসস্থান গড়ে তুলেছেন। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই শান্তিপ্রিয়। শোনা যায় যে কিছু আন্তর্জাতিক অপরাধীরাও এদের মধ্যে শামিল। নিঃশব্দে জীবন যাপন করছে তারা। এদের মধ্যে অবশ্যই আছে সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে পালিয়ে আসা প্রচুর শরণার্থী --- ইরাক, আফগানিস্থান, সোমালিয়া, সিরিয়া এবং আরো অনেক দেশ থেকে।
জাস্টিন ট্রুড্যো তাঁর শরণার্থী-আমন্ত্রণের অভিপ্রায়ে কিছু গলতি করেননি বলে আমি মনে করি। প্রায় ১০,০০০ এর বেশী সিরিয়ার শরণার্থী আজ নির্ভাবনায় কানাডায়। কিন্তু আজ এই ধীর, স্থীর কানাডাবাসীর ললাটেও ভ্রুকুটী। যদিও কোন বিশেষ সরলরেখা টানা যাচ্ছেনা এই একটার পর একটা ঘটনাগুলোর মধ্যে, এবং টরন্টো পুলিশ কিছুতেই ঝপ্ করে কোন সন্ত্রাসবাদী বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়কে এর কৃতিত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী নয়, তবুও কোথায় যেনো একটা খটকা লাগছে। সিরিয়ার শরণার্থীর প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়ার পর থেকেই এই নির্মল দেশটির ঘন, নীল আকাশে যেনো কালো মেঘের ঘনঘটা। সবই কি কাকতালীয়?
আমেরিকা যেমন সব কিছুতেই আইসিসকে, মুসলিমদের দোষ দিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়, কানাডা কিন্তু অতো সহজে ব্যাপারটাগুলোর নিষ্পত্তি করতে বোধহয় চাইছে না। মাঝে আবার মে মাসে টরন্টোর মিসিসাগায় এক ভারতীয় রেস্তোঁরায় বোমাবাজি হয়েছিল। ‘বম্বে ভেল’ নামক রেস্তোঁরায় দু’জন লোক ঢুকে একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। ভিতরে একটা জন্মদিনের পার্টি চলছিল। সেখানে উপস্থিত ৪০ জনের মধ্যে ১৫ জন আহত হলেও, গুরুতর আঘাত পাননি কেউই। কারণ এখনও অজানা, তবে পুলিশের অনুমান, এটি কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলা নয়, নিছক ‘বিজনেস রাইভালরি’।
তাই আপাতত প্রত্যেকটা ঘটনারই আলাদা বিশ্লেষন। তবে একটা চাপান-উতোর শুরু হয়ে গেছে মানুষের মধ্যে। সেটি কিন্তু ঠিক ঘৃণা-প্রশ্রয়কারী আবেগ নয়। বরঞ্চ, অবাক হয়ে যাই, যে মানুষের মধ্যে অনেকটাই ঘৃণা নিষ্কাশনের প্রচেষ্টা তৈরি হচ্ছে। সকলে যেনো জানে যে, বাবা, অনেক ঘৃণা দেখেছি, আর নয়। তাঁরা যেন ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরান। এমনকি, সংবাদমাধ্যমও অনেক সংযমী, দায়িত্বপূর্ণ। কোন খবরে আগুন ছড়াবে সে ব্যাপারে তারা ভীষণ সচেতন। আমাদের ভারতের মতন নয়, যে ধোঁয়া দেখেই আগুনের ঘোষণা করে দিল চ্যানেলে চ্যানেলে, আসামী ঠিক করে তার ফাঁসি পর্যন্ত দিয়ে দিল সংবাদমাধ্যম!
গত রবিবার এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। কিছু মানুষ টরন্টোর ড্যানফর্থে ইসলাম-বিরোধী এক বিক্ষোভকারীকে ধাক্কা দিয়ে ফোয়ারার জলে ফেলে দেয়। তারা কিন্তু শুধুই মানুষ ছিল – সাদা, কালো, খয়েরি, হলুদ, নানান রঙের। সবাই এক সঙ্গে একসুরে বলতে থাকে, “শেম! শেম!”
আগুনের কাজ জ্বলা। মানুষের কাজ সেটা নেভানো, উস্কানো নয়। এই সামান্য কাজটাই কীরকম গৌরবান্বিত করা হচ্ছে, তাই না? কিন্তু এটাই স্বাভাবিক। যদিও কিছু গোঁড়া মানুষ সবসময়েই সমাজকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেই, তবুও যে সমাজে এই ধরনের যৌথ প্রতিবাদ, যেখানে স্ফুলিঙ্গ আগুনের আকার নেওয়ার আগেই নিভিয়ে দেওয়া হয়, সেই সমাজে আমার মনে হয় শান্তিরই জয় অবশ্যম্ভাবী! শান্তিই সর্বোত্তম - সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।