টানা প্রায় দেড় মাস কাজ বন্ধ। শেষ কবে হয়েছে এমনটা? বাঙালির মনে পড়ে? সেই দু-তিন দশক আগে পুজোর লম্বা ছুটিতে বেড়াতে টেড়াতে যাওয়া হত এককালে। বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে রায়বাবু গিন্নি, বাচ্চাকাচ্চা সমেত চললেন হাওয়া বদলে। ফিরবেন ২৬ দিন পর। সময় বদলেছে, দিন বদলেছে, বেড়াতে যাওয়ার চরিত্রও বিস্তর বদলেছে।দেশের ভেতর যেতে হলে এখন সব দিন সাতেকের ঝটিকা সফর। ইয়োরোপ আমেরিকা হলে বড়জোর দিন ১০ থেকে ১৫। তো করোনায় তো সে সব বারণ! সিনেমা, নাটক, ফুটবল ম্যাচ সব বন্ধ। তর্ক, অড্ডা-গল্প, গান সবই তো বন্ধ। আরে মশায়, পরিবার ছাড়া আর দুটো মানুষের মুখ পর্যন্ত দেখতে পাবেন না আপনি। করবেন কী?
জানলা দিয়ে ও বাড়ির মাসিমা মেসোমশায়কে ডেকে কুশল সংবাদ নেওয়া হয়ে গেলে একটু জিরিয়ে নেওয়া, একটু পাশ ফিরে শোয়া, টিভি চালালেই ম্রিত্যুমিছিল দেখলে মনখারাপ। তাও আর বেশি দিন না, কেবলের লোক পয়সা চাইতে না আসলে আপনা থেকেই বন্ধ হবে বোকা বাক্সটাও।
আরও পড়ুন, দশক বিদায়! বাঙালি জীবনে কী এল, কী হারাল?
এবার সম্বল ওই সাধের মুঠোফোনটা। ওখানেই খানিক সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরঘুর, তারপর খানিক মিমচর্চা, তারপর হোয়াটস আপ!
সব গল্প ফুরিয়ে যাচ্ছে বড় তাড়াতাড়ি, তাই স্মৃতিতে ফেরা। কিন্তু হোয়াটসআপের তালিকায় থাকা বন্ধুরা কেউ শৈশবের নয়। তাই স্কুলজীবনের সাদা-কালো অ্যালবাম ভাগ করে নিতে কুণ্ঠা হয়। মফঃস্বলের আমের মুকুলের গন্ধও গ্রুপে পাঠানো যায় না। তবে মিল কেবল দুটি জায়গায়। সুর আর সাহিত্য! দিনভর তাই চলে গানের দেওয়া নেওয়া।
লকডাউনের প্রথম দিনেই কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে চলল বই চালাচালি। হ্যাঁ সালটা তো ২০২০। স্মার্টফোন মারফৎ যে বই আসে, তাকেও যে স্মার্ট হতেই হয়। বাংলাজুড়ে নানা গ্রুপে এদিন দেদার বিলি হল বাংলা বই-এর পিডিএফ। তাতে রয়েছে যকের ধন, ফেলুদা সমগ্র, শিবরাম সমগ্র, টেনিদা সমগ্র, পরশুরাম, বিমল কর, টিনটিন, হাদা ভোঁদা, সেরা সন্দেশ, বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহ, শুকতারা, চাঁদমামা। বাঙালি আবার বই পড়ছে! সাহিত্য নিয়ে আলাপ করছে! স্মৃতি রোমন্থন করছে! গায়ে কাঁটা দেয় না?
আরও পড়ুন, পাল্টানো সময়ের বড়দিন, অ্যামাজনে আসে সান্টার উপহার
আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ্ব বই দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। আজ কী বার? অবশ্য এখন প্রতিদিন রোববার। প্রতিটা দুপুর রবিদুপুর। নিশ্চয়ই এই শহরের অথবা মফঃস্বলের কোনও এক খুদে দাদু ঠাম্মার মাঝে শুয়ে একমনে শুকতারার গল্প শুনছে। ঘনঘন আসা প্রশ্নে তিতিবিরক্ত মায়েরা, মাসিরা, কাকারা, জেঠিরা। 'পিদিম কী গো, সলতে মানে? দেখিনি তো কখনও? মোবাইল স্ক্রিনে একটানা চোখ রেখে দাদুর চোখ তখন কুটকুট করছে, নাকি ঝাপসা হচ্ছে অন্য কোনও কারণে...
করোনার দিন ফুরোলে বাংলায় একদিন নিশ্চয় লেখা হবে এই তিন হপ্তার কথা, ঘরবন্দি থাকার কথা, নিতান্ত আটপৌরে যাপনের কথাও। দাদুর চশমার ঝাপসা কাঁচের কথা লেখা থাকবে তো?