করোনার শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ। রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু সুস্থ হওয়া একাংশের শরীরের আরও নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক মহল। বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ হয়েছে। যে বিষয়টি চিকিৎসক এবং গবেষকদের ভাবাচ্ছে, এর নাম তাঁরা দিয়েছেন ‘লং কোভিড’। ল্যানসেট-এ প্রকাশিত গবেষণায় জানানো হয়, দু লাখের বেশি মানুষের ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডের পর ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনির রোগসহ, স্ট্রোকের হার বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই লং কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসা নিতান্তই জরুরি, জানিয়েছেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ইন্দ্রজিৎ ঘোষ।
লং কোভিড কী-
লং কোভিড’ কী? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, উপসর্গযুক্ত করোনা আক্রান্তের একাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরেও তাঁদের শরীরে নানা নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। যেমন, মাথা ব্যথা, ঘন ঘন জ্বর আসা, ফুসফুসের সমস্যা, চামড়ায় ফুসকুড়ির মতো কিছু হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক হতাশা ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে খবর।
পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে করোনা আক্রান্ত ৮০ শতাংশই উপসর্গহীন বা অল্প উপসর্গযুক্ত। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষ্মণ থাকে। এই ২০ শতাংশের মধ্যে চার থেকে পাঁচ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন। তবে দাবি, করোনা-নিউমোনিয়া আক্রান্ত ১৫ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পর, তাঁদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের উপসর্গ। যার মধ্যে ফুসফুসের দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বাড়িয়েছে চিকিৎসকদের। অনেকে আবার লং কোভিড এফেক্টে প্রাণও হারিয়েছেন।
লং কোভিডের লক্ষণ-
• বুক ধড়ফড়
• মাথা ঘুরে যাওয়া
• মাথা ঝিমঝিম করা
• কাটানো যাচ্ছে না ক্লান্তি
• যে কাজটি অয়ায়াসেই করতেন, তা করতে অনীহা লাগছে
• একটু পরেই বুক ধড়ফড় করছে
• কান পাতলেই যেন শোনা যাচ্ছে বুকের ধুকপুকানি
• কেউ হয়ত দীর্ঘদিন গন্ধ পাচ্ছেন না
• কারও কাশি চলতেই থাকছে
• সিঁড়ি দিয়ে উপর নীচ করলেই হাঁফ ধরছে।
• হজম হচ্ছে না সহজ ভাবে।
লং কোভিডের চিকিৎসা-
প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডক্টর অতীন বন্দোপ্যাধায় জানাচ্ছেন ‘‘করোনা মুক্ত হওয়ার পর রোগীদের মধ্যে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। ফুসফুসের সমস্যাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এই বিষয়ে গবেষণা দরকার। কোভিড পরবর্তী অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে দরকার গ্রেড অনুসারে থেরাপি। কোভিডমুক্ত হওয়ার ঠিক কতদিন পর থেকে কতটুকু পরিশ্রম করা যাবে, কতটা এক্সারসাইজ করা উচিত, সবটাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে”।
“কোভিড পরবর্তী ক্ষেত্রে অনেককেই ঘিরে ধরছে অবসাদ। যে কোনও কাজ করতে অনিচ্ছে, কাজ শেষ না করে উঠে পড়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতেই পারে। সেক্ষেত্রে জোর করে কিছু শুরু না করে আস্তে আস্তে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে”।
ডা.বন্দোপাধ্যায় জানালেন, “কোভিড বিভিন্ন অঙ্গে তার ছাপ রেখে যায়। হৃদপিণ্ড, ফুসফুস থেকে পরিপাকতন্ত্র, সব কিছুর উপরই করোনা ভাইরাস তার আঁচড় রেখে যেতে পারে। তা জানান দেয় কোভিড মুক্ত হওয়ার পরই। এই পোস্ট কোভিড সিম্পটম কিন্তু মারাত্মক জায়গায় যেতে পারে। কোভিড সারার পরও ফুসফুস পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে না অনেক সময়ই। বেশি পরিশ্রম করতে গেলেই সেটা টের পাওয়া যায়। মানুষ হাঁফিয়ে ওঠেন। অক্সিজেন লেভেল ড্রপ করে”। এই লক্ষণ দেখলেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কোভিডের পর হার্টেও থেকে যাচ্ছে অসুস্থতা। মাঝে মাঝেই বুক ধড়ফড় করা, নিজের হার্ট-বিট শুনতে পাওয়া, এই অসুখের লক্ষণ। এই লক্ষণ দেখলেই সতর্ক হতে হবে। সেক্ষেত্রে কিছু ওষুধ শুরু করতে হবে। এই লক্ষণগুলির একটিও দেখলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। চিকিৎসকরা বেশ কিছু পরীক্ষা করে দেখে নেবেন, আপনার সমস্যার শিকড় কোথায়। সেই অনুযায়ী দেওয়া হবে ওষুধ।
করোনা মুক্ত হওয়া শিশুদের মধ্যে ‘লং কোভিড’এর প্রভাব দেখা দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘করোনা মুক্ত হয়ে ওঠার পর শিশুরা কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে মাথার যন্ত্রণা, ঘন ঘন পেট খারাপ ইত্যাদি। সত্যিই উদ্বেগের। এ নিয়ে গবেষণা দরকার।’’ তিনি জানিয়েছেন ‘লং কোভিডের ক্ষেত্রে অনেক সময় শিশুদের মধ্যে একটা মানসিক উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে’।
২৮ ডিসেম্বর কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন হুগলির বাসিন্দা রিপর্না মজুমদার, সুস্থ ওঠার পর থেকেই কিন্তু নতুন কিছু রোগ বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরের। মাঝেমধ্যে মাথার যন্ত্রণা তো হয়ই। তার সঙ্গেই উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিয়েছে রিপর্ণার। এই সমস্যা তাঁর আগে ছিল না বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘করোনা মুক্ত হয়ে আসার পর থেকে নিয়মিত প্রেসারের ওষুধ খেতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে মাথার যন্ত্রণা হয়। অল্প কিছুতেই আঁতকে উঠি। মনে সব সময় একটা ভীতি ভাব কাজ করছে।’’