তিনি জ্ঞান আর গুণের সাগর। অমঙ্গলহারী, যার অর্থ মঙ্গলের দেবতা। যাঁর কথা রামায়ণ আর মহাভারত, দুই মহাকাব্যেই আছে। মহাকাব্য অনুযায়ী, তিনি অমর। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর আর কলি- সব যুগেই তিনি পরিত্রাতা। ভগবান শিবের অংশ, একাদশ রুদ্র। ভক্তদের বিশ্বাস, মন-প্রাণ দিয়ে ডাকলে সংকটে হনুমানজি রীতিমতো সাড়া দেন। পরিত্রাতার মতোই করে দেন পথ।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হনুমানজির বহু মন্দির আছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রীতিমতো জাগ্রত বলেই মনে করেন ভক্তরা। তার মধ্যে প্রথমেই যার নাম করতে হয়, তা হল হনুমানগঢ়ি। হনুমানজি শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত। হিন্দিতে গানের কলি রয়েছে, 'পার না লাগো গে, শ্রীরাম কে বিনা। রাম না মিলেঙ্গে হনুমান কে বিনা।' যার অর্থ, শ্রীবিষ্ণুর অবতার শ্রীরামের দর্শন পেতে গেলে, আগে হনুমানজির দর্শন করা উচিত। শ্রীরামের জন্ম অযোধ্যায়। আর, অযোধ্যার ঠিক মাঝখানে হনুমানগঢ়ি। যা হনুমানজির অন্যতম প্রাচীন মন্দির।
হনুমানজির দ্বিতীয় জাগ্রত মন্দির রয়েছে উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে। এই মন্দিরকে বলা হয় সংকটমোচন হনুমান মন্দির। অসী নদীর তীরে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এই মন্দির। কথিত আছে, যেখানে এই মন্দির, সেখানেই হনুমানজির দর্শন পেয়েছিলেন গোস্বামী তুলসীদাস। ভক্তদের বিশ্বাস, যাঁরা এই মন্দিরে নিয়মিত আসেন, তাঁরা হনুমানজির আশীর্বাদ পান।
প্রতি মঙ্গল এবং শনিবার এই মন্দিরে ভক্তরা গ্রহদোষ খণ্ডনের জন্য বিশেষ পুজো দেন। হনুমান জয়ন্তীর দিন, দুর্গামন্দিরের কাছে দুর্গাকুণ্ড থেকে হনুমান মন্দির পর্যন্ত এক বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। এই মন্দিরে ভক্তরা নিয়মিত হনুমান চালিশা এবং সুন্দরকাণ্ড পাঠ করেন। মন্দির থেকে এই বই দুটি বিতরণও করা হয়। প্রতি বছর এপ্রিলে মন্দিরে 'সঙ্কটমোচন সংগীত সমারোহ' নামে ধ্রুপদী সংগীত ও নৃত্যের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন শিল্পীরা।
আরও পড়ুন লোকনাথ বাবার তিরোধান দিবসে জানুন তাঁর অলৌকিক মাহাত্ম্য
হনুমানজির তৃতীয় জাগ্রত মন্দির রয়েছে বারাণসীরই দুর্গাকুণ্ডে। এই দুর্গাকুণ্ড এবং দুর্গামন্দির তৈরি করেছিলেন নাটোরের রাজমাতা রানি ভবানী। তার ঠিক কাছেই রয়েছে বনকোটি হনুমান মহারাজের মন্দির। কথিত আছে, টানা ৪৫ দিন বনকোটি হনুমান মহারাজের দর্শন করলে, হনুমানজি ভক্তের মনোকামনা পূরণ করেন।
হনুমানজির চতুর্থ জাগ্রত মন্দির রয়েছে রাজস্থানের দৌসা জেলার শ্রীমেহান্দিপুরে। যা শ্রীমেহান্দিপুর বালাজি মন্দির নামে পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস, এই মন্দিরের শক্তি এতটাই যে নাস্তিকও এখানে এলে আস্তিক হয়ে যান। এখানে বীর হনুমানের পুজো করা হয়। মূর্তিটি হাজার বছরের পুরনো। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই মন্দিরে 'কালা জাদু'র প্রভাব দূর করতে এবং 'ভূত ঝাড়াতে' আসেন। মন্দিরের ভিতরে সবসময় মন্ত্র পাঠ হয়। আর, ঘণ্টাধ্বনি বাজে। এখানে হনুমানজিকে কোনও ফুল নিবেদন করা হয় না।
আরও পড়ুন আশ্চর্য হলেও চাঁদের আলোয় রাখা জল, শরীরের পক্ষে খুব কার্যকরী, জানুন
হনুমানজির পঞ্চম জাগ্রত মন্দিরটি রয়েছে গুজরাতের সারংপুরে। এখানে হনুমানজি ৪৫ কিলো সোনা এবং ৫০ কিলো রুপো দিয়ে তৈরি সিংহাসনে উপবিষ্ট। তিনি কষ্টভঞ্জন, অধিরাজ এবং মহারাজ নামে খ্যাত। এখানে হনুমানজির পায়ের তলায় শনিদেব আর সোনার গদা রয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস, এই মন্দিরে এলে শনিদেবের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পাশাপাশি, ভক্তদের মনোস্কামনাও পূরণ হয়।
শুধু ভারতই নয়, শ্রীলঙ্কাতেও হনুমানজির পুজোর চল রয়েছে। কথিত আছে, রামচন্দ্রের লীলা অবসানের পর হনুমানজি লঙ্কায় গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ পর্বত পেদ্রোতালাগালায়। কথিত আছে, সেই সময় নাকি তিনি সেখানকার আদিবাসীদের একটি গোপন মন্ত্র শিখিয়ে দেন। যা জপ করলে ভক্তের সামনে আবির্ভূত হবেন বলেই হনুমানজি আশীর্বাদ করেছিলেন। মন্ত্রটি হল, 'কালতন্তু কারেচরন্তি এনর মরিষ্ণু, নির্মুক্তার কালেত্বম অমরিষ্ণু।'
আরও পড়ুন- কী আছে কেদারনাথে, যার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা?
এসব ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়া রেল স্টেশনের কাছে রয়েছে মাদরাল বীর হনুমান মন্দির। বহু পুরোনো এই মন্দিরের হনুমান মূর্তি বেশ জাগ্রত বলেই বিশ্বাস ভক্তদের। তবে, এখানে রয়েছে হনুমানজির শায়িত মূর্তি। যা গোটা দেশে এলাহাবাদের মতো হাতেগোনা কয়েকটি জায়গাতেই কেবল রয়েছে।
এবার আসা যাক, কীসে হনুমানজি সন্তুষ্ট হন, সেই ব্যাপারে। পুরোহিতদের মতানুসারে, সিঁদুর, কাঁচা সরষের তেল, আর লাড্ডু দিয়ে হনুমানজির পুজো করা হলে তিনি খুশি হন। লাল ফুল আর হলুদ ফুল দিয়ে পুজো করাই বিধেয়। ভক্তদের বিশ্বাস, আরাধনার সময় হনুমান চালিশা পাঠ করলে হনুমানজি খুশি হন।