কনকনে ঠান্ডা, কারও গায়ে সোয়েটার, কারওবা গায়ে উঠেছে শাল-চাদর, কারও গলায় মাফলার, আবার কারও মাথায় হনুমান টুপি। এ বেশেই তাঁরা মাঠে পা মুড়ে বসে রয়েছেন। কেউবা আবার সঙ্গে করে মুড়ি-তেলেভাজা এনেছেন, আবার কারও টিফিন বক্সে উঁকি মারছে লুচি-তরকারি। কারও গলায় আফশোসের সুর, ''একটু যদি আগে আসতে পারতাম, সামনে বসতাম।'' কেউ আবার মোবাইলের ক্যামেরা বারবার করে দেখছে , যাতে ছবি তোলার সময় কোনও গড়বড় না হয়। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে ''আর মাত্র কিছুক্ষণ।'' রুপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকার অপেক্ষায় শেষ মুহূর্তে সেও একেবারে সেজেগুজে তৈরি। সে বলতে তিন দিক খোলা মঞ্চ। বছরের পর বছর ধরে বিশেষত গ্রামবাংলায় যে মাত করছে। তার ভাল নাম মিউজিক্যাল ট্রুপ, তবে ডাক নামেই তাকে সকলে চেনে। হ্য়াঁ, 'মাচা'।
নেটফ্লিক্স-ফেসবুকের যুগে আজও গ্রামবাংলার বিনোদনের অন্য়তম রসদ এই 'মাচা শো'। পছন্দের নায়ক-নায়িকাকে হাতের নাগালে পেতে এই শোয়ের জুরি মেলা ভার। শুধু কী তাই, সাধের দর্শকদের হাততালির আওয়াজ শুনতে মুখিয়ে থাকেন টলিপাড়ার তারকারও। পাশাপাশি সেলেবদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্সও বাড়ে।
মাচা শো দেখতে ভিড়। ছবি: ইউটিউব।
কেন মাচা শোয়ের এত রমরমা? জবাবে এই শোয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা অতনু সরকার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বললেন, ''১০০ বছর আগেও ছিল, আশা করি ১০০ বছর পরেও এর জনপ্রিয়তা থাকবে। স্বপ্নের নায়ক-নায়িকাকে চোখের সামনে দেখা, চাহিদা তো হবেই। দিনকে দিন এর চাহিদা বাড়ছে।'' এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, ''গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের জন্য এটাই অন্যতম মাধ্যম এখনও। তাছাড়া নায়ক-নায়িকাদের সামনে থেকে দেখার একটা খুব বড় সুযোগ মাচা।'' রচনার সুরেই সুর মেলালেন শ্রাবন্তী, তিনিও বললেন, ''গ্রামে সেভাবে এন্টারটেনমেন্ট বলে কিছু নেই। চোখের সামনে নায়ক-নায়িকাদের দেখতে পেয়ে খুব মজা পান ওঁরা।'' শুভশ্রীরও এক বক্তব্য, ''স্টারদের লাইভ দেখতে পায় মানুষ, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে পারেন সরাসরি।'' অঙ্কুশের কথায়, ''এমন এমন জায়গায় শো হয়, সেখানে এন্টারটেনমেন্টের সেভাবে কোনও মাধ্যম নেই। আর আমাদের দেখার একটা চাহিদা তো থাকেই।''
আরও পড়ুন, সিঙ্গল স্ক্রিনের সোনালি দিন আজও ভোলেননি এই তারকারা
যদিও এই শোয়ের আরেক উদ্যোক্তা তোচন ঘোষের দাবি, ''আগে যে পরিমাণ মাচা শো হত, এখন সে তুলনায় অনেক কম হচ্ছে। আগে মেদিনীপুর শহর মাচা শোয়ের এক নম্বর জায়গা ছিল। চিটফান্ড সমস্যার জেরে খুব প্রভাব পড়েছে মাচায়। গ্রামে যেসব ছোটো ছোটো চিটফান্ড ছিল, সেগুলো বন্ধ হওয়াতে এ ধরনের শো কমে গিয়েছে।'' তাঁর কথায়, মূলধারার বাণিজ্যিক বাংলা ছবির মন্দা বাজারও এজন্য দায়ী। তোচনবাবু বললেন, ''এ কারণেই বম্বের শিল্পীদের এত চাহিদা এখন এই শোয়ে।''
মাচা শোয়ের জন্ম হল কীভাবে? অতনু সরকার জানালেন, ''এটা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে। আগে নাম ছিল 'জলসা'। তখন অত ফিল্ম আর্টিস্টদের ভিড় ছিল না। আগে উত্তম কুমার যেতেন। ২-৫ মিনিট স্টেজে থাকতেন, তারপর চলে যেতেন। ২০-২৫ বছর হল আমি এ ধরনের শো করছি। আসলে আমি ফর্ম্যাট বদলে এমন শো করা শুরু করি। নাম দিই 'মিউজিক্যাল ট্রুপ'। এজন্য বুম্বাদার অনেক অবদান রয়েছে। বুম্বাদার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই এমন শো করার। ফিল্মস্টাররা পেশাদার হিসেবে এই শো করতে পারবেন, একথা বোঝাই। প্রথম আমি প্রসেনজিৎ মিউজিক্যাল ট্রুপ করি।''
তিনি আরও বললেন, ''মানুষের কৌতূহল হয়েছিল, যে মিউজিক্যাল ট্রুপ কী? এজন্য ৫-৭ বছর সময় লেগেছে বোঝাতে। এরপর ঋতুপর্ণা মিউজিক্যাল ট্রুপ করি। পরে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা শো করি, খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে অন্য ফিল্মস্টাররাও করতে আসেন এই শো।'' এ প্রসঙ্গে প্রসেনজিৎও বললেন, ''আমি খুব গর্বের সঙ্গে বলতে পারব যে, আজ থেকে ২৫ বছর আগে অর্গানাইজড ভাবে মাচা শো করাটা প্রসেনজিৎ শুরু করেছিল।''
https://www.youtube.com/watch?v=WYIDUhq0zBU
মাচা নাম হল কীভাবে? জবাবে অতনুবাবু বললেন, ''এটা মিডিয়ার তৈরি করা। সবাই এখন মুখে এটাই বলেন।'' তবে মাচা নামকরণ নিয়ে খুব একটা খুশি নন আরেক উদ্যোক্তা তোচন ঘোষ। তাঁর কথায়, ''লোকের মুখে হয়ে গিয়েছে এখন এই নাম। তবে আমি বলব এটা খারাপ হল। মাচা শব্দটা খারাপ।''
২০-৩০ হাজার মানুষের সামনে দাঁড়ানো, শুধু কী তাই, রীতিমতো পারফর্ম করা, এ তো চাট্টিখানি কথা নয়। কেমন প্রস্তুতি থাকে? অতনু সরকার বললেন, ''এখানে সকলকে গান গাইতে হয়। অর্থাৎ নায়ক-নায়িকারা নিজেরাই গান করেন। তাই আমরা তাঁদের রিহার্সাল করাই। কোন শিল্পী কোন গান গাইবেন, তা বাছা হয়। মূলত শিল্পীদের নিজেদের ছবির গানই বাছা হয়। এরপর অডিও তৈরি করা হয়। শিল্পীরাও বাড়িতে প্রথমে প্র্য়াক্টিস করেন। এরপর ব্যান্ডের সঙ্গে রিহার্সাল করানো হয়।মূলত পুজোর পর থেকে মাচা শোয়ের মরশুম শুরু হয়। আমরা জুন-জুলাই-অগাস্টের মধ্য়ে সব প্রস্তুতি সেরে নিই।''
মাচা শো করার পরই তিনি প্রশংসা পেয়েছেন, ''রচনা খুব ভাল গান করেন।'' এ প্রসঙ্গে দিদি নং ১ বললেন, ''সুর-তাল জ্ঞান থাকলেই হয়ে যায়, আর ঘষামাজা করতে হয়। ১৮ বছর ধরে করছি, অভ্য়েস হয়ে গিয়েছে।'' প্রথম প্রথম মাচা শোয়ে গেলে ভয় করত এই মুহূর্তে টলিপাড়ার প্রথম সারির মুখ নুসরত জাহানের। তাঁর কথায়, ''প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগত। এখন খুব মজা পাই। এত মানুষের হাততালি যখন পাই বেশ ভাল লাগে। গত কয়েকবছরে শো করে খুব ভাল সাড়া পেয়েছি।'' নুসরতের মতোই প্রথম প্রথম মাচা শো করা নিয়ে টেনশনে থাকতেন শ্রাবন্তী। তিনি বললেন, ''প্রথমদিকে টেনশন হত। এখন অবশ্য় সহজ হয়ে গিয়েছে।'' মাচা শোয়ে গিয়ে রীতিমতো ডান্স পারফরম্য়ান্স করেন টলি স্টার অঙ্কুশ। তিনিও বললেন, ''শোয়ের আগে নাচের রিহার্সাল করতে হয়।''
তবে সবাই মাচায় সড়গড় হতে পারেন না। এ ব্য়াপারে অতনুবাবু জানালেন, ''সব আর্টিস্টরা পারেন না কিন্তু এসব করতে। যাঁরা ভাল করতে পারেন, তাঁরাই বেশি ডাক পান।''
আরও পড়ুন, বাংলা সিনেমার বৃষ্টিভেজা নায়িকাদের গল্প
হাজার ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে রেখে মাচা শো করতে গ্রামবাংলা ছুটে যান টলি তারকারা। কীসের টানে? শুধুই কি টাকা? জবাবে টলিউড হার্টথ্রব ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বললেন, ''দর্শকদের কাছ থেকে খুব ভাল ফিডব্যাক পাওয়া যায়। দর্শকদের সঙ্গে খুব ভাল কানেক্ট করা যায়। একজন শিল্পীর কাছে এই কানেকশনটা খুব দরকার। দর্শকদের পালস বোঝা যায়।'' দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া চেটেপুটে উপভোগ করার লোভ ছাড়েন না নুসরত, শুভশ্রী, শ্রাবন্তীরাও। তাঁদের সকলের কথাতেই, ''খুব এনজয় করি, যখন দর্শকরা হাততালি দেন, চিয়ার আপ করেন,দারুণ লাগে,।'' প্রিয় দর্শকদের কথা মাথায় রেখে মাচা শোতে কার্যত জান লড়িয়ে দেন টলিউড 'ইন্ডাস্ট্রি' প্রসেনজিৎ। তিনি বললেন, ''মাচা শোকে কখনই টাইমপাস হিসেবে নিই না। মাচার দর্শকরা শুধু প্রসেনজিৎকে দেখতে আসেন না কিন্তু, ওঁদের জন্য পারফর্ম করতে হয়। দর্শকরা অনেক আশা নিয়ে আসেন।''
মাচা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নেহাত কম নেই। অমুক নায়ক-নায়িকা আর 'ছবি পাচ্ছেন না, তাই মাচা করে রোজগার করছে' গোছের কথা প্রায়শই শোনা যায়। সেই সমালোচনা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই প্রসেনজিৎ বললেন, ''শাহরুখ খান-সলমন খান লন্ডন-আমেরিকায় শো করতে পারেন, কারণ সেখানে তাঁদের মার্কেট রয়েছে, আমাদের বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দর্শকরা এখানকার। তাঁরা সেখানে শো করে যদি অতিরিক্ত রোজগার করেন, তাহলে মানুষ এটা নিয়ে কেন সমালোচনা করবেন? আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মাচায় শো করলে যদি কেউ হাসাহাসি করেন, তাহলে তা খুব লজ্জার। একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর শরীর খারাপ হলে, অসুস্থ হলে, বা কেরিয়ারে ওঠানামা হলে, তখন তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। সবার কেরিয়ার তো টানা ৩৫-৪০ বছর ধরে টিকে থাকে না। মাচা শো একটা খুব বড় সাপোর্ট।''
মাচা শোয়ে টাকা রোজগার নিয়ে রচনার সাফ কথা, ''যাঁরা ব্য়ঙ্গ করেন, তাঁরা তো আমার সংসার চালাবে না। পয়সার জন্য কাজ করি, সোজা কথা। সবাই তাই করি। যাঁরা হাসাহাসি করেন, তাঁরা তো এক পয়সা দেবেন না। কে কী হাসল, কিছু যায় আসে না।'' মাচা শিল্পীদের টাকা রোজগারের একটা বড় মাধ্য়ম বলেই মনে করেন অঙ্কুশ। তাঁর বক্তব্য়, ''মাচা শো করে অনেকেই বাড়ি-গাড়ি করেছেন। যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরাও ভাল রোজগার করছেন। আসলে একই জিনিসটা যদি সায়েন্স সিটি কিংবা সল্টলেক স্টেডিয়ামে হত, তাহলে কেউ কিছু বলত না। এই একই শো গ্রামে হলে যেখানে বালিগঞ্জ বা সাউথ সিটির মানুষরা দর্শকাসনে থাকেন না, তখন এত কথা হয়।''
আরও পড়ুন, ভূত-চতুর্দশীর আগে ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার গপ্পো টলিপাড়ার ছয় কন্যার
এই মুহূর্তে মাচা শোয়ে নায়িকাদের মধ্য়ে সবথেকে বেশি চাহিদা নুসরত জাহানের। তিনি বললেন, ''যাঁরা এসব ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেন, তাঁরা আসলে এসব শো করার ডাক পান না। এই শো করা মোটেই সহজ নয়। ওই দর্শকরা না থাকলে আমাদের কেউ নায়িকা বলে ডাকত না।'' টলিপাড়ার আরেক নায়িকা শ্রাবন্তী বললেন, ''মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছি, এটা আরেকটা পুজো করার মতো। যাঁদের ঠাট্টা করার করুক, কিছু আসে যায় না।'' শ্রাবন্তীর মতো একই সুর শোনা গেল শুভশ্রীর গলায়। তাঁর বক্তব্য়, ''আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে তো কিছু করছি না, কোনও অপরাধ তো করছি না, তাহল অসুবিধে কোথায়? যাদের কোনও কাজ নেই, তারা এসব বলে।''
টেলিভিশন স্টারদের মধ্যে এই মুহূর্তে মাচা শোয়ের প্রধান মুখ 'ফাগুন বউ'এর মহুল মানে, ঐন্দ্রিলা। তিনি বললেন, ''পাশের বাড়ির কাকুকে দু'মিনিট মুখ দেখার জন্য় এক লাখ টাকার চেক দেবে না। সেই যোগ্য়তা অর্জন করতে হবে আগে। এটা বড় রোজগার। এসব ব্য়ঙ্গ-বিদ্রুপে কান দিই না।'' মাচা শোয়ের অন্য়তম উদ্য়োক্তা অতনুবাবুও বললেন, ''ঠাট্টা-ইয়ার্কির ব্যাপার নেই, মানুষ কোন স্টারকে দেখতে চাইবে, এটা তো ভাগ্যের ব্যাপার। বড় স্টার না হলে তো মানুষ তাকে দেখতে যাবে না।''