গোটা একবছরের অপেক্ষার পর দুর্গাপুজোর ইঙ্গিত মানেই বাঙালি জানে মহালয়া। একের পর এক দিন গুনতে গুনতে মহালয়ার ভোর মানেই বাঙালির প্রতীক্ষার অবসান। মা দুর্গা আসছেন এই আনন্দেই যেন পলক পড়ে না পুজোপ্রেমী বাঙালির। সারাবছর যেমন খুশি হোক, এই তিথিতে ভোর ৪টে মানেই জেগে পড়ো বাঙালি, উৎসবের শুরু। তবে এই নিয়েই বেঁধেছে গোলমাল।
যথারীতি, শুভ মহালয়া শব্দটি আমজনতা সকলেই সোশাল মিডিয়া থেকে চ্যাট বক্স ব্যবহার করে থাকেন সৌজন্য বোধের উদ্দেশ্যে। তবে এইবার যেন একটি বিপত্তির সৃষ্টি চারিদিকে। কারওর কথায় মহালয়া নাকি শুভ নয়? এতদিনের বিশ্বাসে যেন এক চরম আঘাত। কিন্তু কোন প্রেক্ষিতে? তার কারণ মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তিল সহযোগে জলদান করা হয়। যার আক্ষরিক অর্থ 'তর্পণ'। তাঁদের বক্তব্য, কারওর শ্রাদ্ধ কর্মসূচি কীভাবে শুভ হতে পারে? অনেকে তো এমনও বলেন, নিশ্চয়ই কারওর বাড়ি গিয়ে এমন বলবেন না শুভ শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান!
আবার চিরাচরিত রীতি মেনে আসা বাঙালিদের কেউ কেউ বলেন, যেদিন দেবীপক্ষের সূচনা, স্বয়ং মা দুর্গার চক্ষুদান পর্বের মাহেন্দ্রক্ষণ আবার এই দিনেই পুরাণ মতে মহাদেবের উদ্দেশে নীলকন্ঠ পাখি যাত্রা করতেন উমার আমন্ত্রণের বার্তা নিয়ে। সেই দিন অশুভ? এ আবার কোনও ভাবে সম্ভব?
যুক্তি তক্কো নিয়ে একেবারে উত্তেজিত নেটপাড়ার বাসিন্দারা। এমনকি ছাড়া হয়নি রেডিওর সেই যুগান্তকারী চণ্ডীপাঠ এবং মহিষাসুরমর্দিনী প্রসঙ্গকেও। বলা হয়, এর সঙ্গে মহালয়ার কোনও যোগ নেই। এটি পূর্বে ষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হত পরবর্তীতে এটিকে মহালয়ার প্রভাতে নির্দিষ্ট করা হয়। সহজ ভাষায় অনেকেই মহালয়াকে শুভ মানতে নারাজ তার কারণ এটি পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করার দিন। কেউ কেউ বলেন দেবীপক্ষের সূচনা মঙ্গল হোক এমনও ভাবা যায়।
কিন্তু তর্পণ আসলে কি? শুধুই কি পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যেই তিল দান! দ্বিমত থাকলেও শাস্ত্র অনুযায়ী তর্পণ মানে নিজের সঙ্গে সঙ্গে দেবতা, ঋষি-মুনি সকলের উদ্দেশ্যে আত্মসন্তুষ্টির নিবেদন। পৃথিবীর সকল মানুষ এবং নিজের পরিবারের সকলের উদ্দেশ্যে মঙ্গল কামনা। 'তৃপ্যন্তু সর্বোমানবা' এই শব্দটির অর্থই সকলের উদ্দেশ্যে তুষ্টি জ্ঞাপন। হিন্দু শাস্ত্রে পাঁচটি যজ্ঞের মধ্যে একটি পিতৃযজ্ঞ, যার অর্থই স্মরণে মনণে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশে জল দান করা। পুরাণ অনুযায়ী, সূর্যপূত্র কর্ণের মৃত্যুর পরেই এই বিধির সূচনা। তাঁর মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে তাঁর দান ধ্যানকে স্মরণে রেখে কেবলমাত্র সোনা খেতে দেওয়া হয় তাঁকে। অবাক ভাবেই যখন এই বিষয়ে তিনি প্রশ্ন করেন জানতে পারেন কেবল দান ধ্যান নয়, পিতৃদানের প্রয়োজন সকল মানবের আছে। ভগবান ইন্দ্রের অনুমতি নিয়েই পরবর্তী ১৬ দিনের জন্য মর্তে আসার পরে নিজ হাতে অন্ন এবং জল প্রদান করেন।
তাই বলে আদ্যশ্রাদ্ধ এবং বাৎসরিকশ্রাদ্ধ, তথা তর্পণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু বৈচিত্র আছে। পিণ্ডদান অর্থ অন্ন এবং তিলের সংযোগে হাত ঘুরিয়ে এমনকি কিছু উপচারে মুখ ফিরিয়ে এই কার্য করতে হয়। তবে তর্পণ সংক্রান্ত কোনও এরূপ নিয়ম নেই। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে নিজের ঔরসজাত সন্তান এবং তাঁদের পরিবারের সকলের অংশগ্রহণ করা আবশ্যিক তবে পিতৃতর্পণ অনুযায়ী এরূপ কোনও নিয়ম নেই। পুরুষদের ক্ষেত্রে 'তিল' এবং নারী প্রসঙ্গে 'যব' দানের সামগ্রী হিসেবে নির্দেশিত। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রথমে পূর্ব তার পরে দক্ষিণ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রথমে উত্তর পরে দক্ষিণ এই আচার মেনেই তর্পণ হয়ে থাকে।
মহালয়া শুভ নাকি অশুভ এই বিষয়ে মতভেদ প্রচুর। একদিকে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান অন্যদিকে উমার আগমন বার্তা, দেবীপক্ষের সূচনায় এই গোলমাল নিয়েই যেন আনন্দে ছোট করে দাড়ি পড়েছে। উৎসবে আনন্দে এই বিদ্বেষ জমতে না দিয়ে উমার আরাধনায় মেতে ওঠার বিষয়ই শ্রেয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন