Advertisment

মোদীর 'মন কি বাত'-এ স্বপ্নপূরণের কাহিনী শোনাবেন বাংলার সহিদুল

দিল্লি পাড়ি দিচ্ছেন বাংলার ট্যাক্সিচালক। 'মন কি বাত'এর ৫০ তম পর্বে নিজের স্বপ্নপূরণের কাহিনী শোনাবেন বারুইপুরের মহম্মদ শহিদুল লস্কর। তবে তাঁর আগেই সেই কাহিনী শোনালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sohidul laskar, সহিদুল লস্কর

'মন কি বাত'এর ৫০ তম পর্বে নিজের স্বপ্নপূরণের কাহিনী শোনাবেন বারুইপুরের মহম্মদ সহিদুল লস্কর।

'ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন' দেখেছিলেন তিনি। পাড়া-পড়শিদের অনেকেই তাঁর স্বপ্নকে তাচ্ছিল্য করতেন। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি। বরং সেই তাচ্ছিল্য, উপহাসই যেন তাঁর মনের জোর বাড়িয়ে দিল। তিনি মহম্মদ সহিদুল লস্কর, বারুইপুরের এক ট্যাক্সিচালক। এ রাজ্যের তো বটেই, গোটা দেশের কাছে তিনি দৃষ্টান্ত।

Advertisment

সালটা ২০০৪, বিনা চিকিৎসায় হারাতে হয়েছিল তাঁর আদরের ছোট বোন মারুফাকে। মারুফার অকাল প্রয়াণই যেন মোড় ঘুরিয়ে দিল সহিদুলের জীবনের। বিনা চিকিৎসায় যেন আর কারও বোনকে চিরতরে বিদায় জানাতে না হয়, এই ব্রত নিয়েই কার্যত অলীক স্বপ্ন দেখেছিলেন সহিদুল। মনে মনে ঠিক করেছিলেন, গ্রামে হাসপাতাল গড়বেন। যেখানে বিনামূল্যে মিলবে স্বাস্থ্য পরিষেবা।

কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া এক ট্যাক্সিচালক কীভাবে পারবেন এই লাখ টাকার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে? সেই অসাধ্য সাধনই করে নজির গড়েছেন শহিদুল। যাঁর কর্মকাণ্ডের কথা এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি 'মন কি বাত'-এ দেশবাসীকে শুনিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবার প্রসার ভারতীর আমন্ত্রণে দিল্লি পাড়ি দিচ্ছেন সহিদুল। রবিবার 'মন কি বাত'-এর বিশেষ পর্ব সরাসরি সম্প্রচার করা হবে, যেখানে নিজের স্বপ্নপূরণের কাহিনী শোনাবেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে সহিদুল বললেন, "প্রসার ভারতীর তরফে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওরা আগামিকাল বিশেষ অনুষ্ঠান করছে, যা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। আজ রাতের ফ্লাইটে দিল্লি যাচ্ছি। এর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারির 'মন কি বাত'-এ প্রধানমন্ত্রী আমার কথা বলেছিলেন।" একইসঙ্গে সহিদুল বললেন, "আমার কথা বলব, আমি যে হাসপাতাল গড়েছি, তার জন্য যদি প্রধানমন্ত্রী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, সে আর্জি জানাব।"

kolkata news, কলকাতার খবর সহিদুলকে পাঠানো আমন্ত্রণপত্র। ছবি সৌজন্যে: সহিদুল লস্কর

দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুরের পুঁড়ি গ্রামে বোনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে হাসপাতাল গড়েছেন সহিদুল। কীভাবে হল এই স্বপ্নপূরণ? "২০০৪ সালে আমার আঠারো বছরের বোন মারুফার হৃদযন্ত্রে জল জমে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরেছিলাম। কিন্তু সব জায়গা থেকে ফেরানো হয়েছিল। শেষমেশ ৩১ ডিসেম্বর বিনা চিকিৎসায় ওর মৃত্যু হয়।" বোনের কথা বলতে গিয়ে বিষন্ন হয়ে পড়েন দাদা। "ওর মৃত্যুর পর রাতের পর রাত ঘুমোতে পারি নি। ভাবতাম, কলকাতায় এতগুলো হাসপাতাল, অথচ বোনের চিকিৎসা করাতে পারলাম না? তাছাড়া, আর্থিক দিক থেকেও আমরা সচ্ছ্বল ছিলাম না। তখনই ভাবি যে, আমাদের গ্রামে যদি স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে পারি কেমন হয়? এরপরই ঠিক করি, হাসপাতাল গড়ব।"

আরও পড়ুন, এই শহরের ধুলোতেই লুকিয়ে আছে সোনা!

হাসপাতাল গড়ার পথটা একেবারেই সহজ ছিল না। ডাক শুনে কেউ আসে নি, একলাই চলতে হয়েছে তাঁকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ''প্রথমে জায়গা খুঁজতে শুরু করি। অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউই সেভাবে তখন এগিয়ে আসেন নি। বরং তাচ্ছিল্য করতেন, উপহাস করে বলতেন, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখছে। অনেকে আবার ভাবতেন, একজন ট্যাক্সি চালক হয়ে কীভাবে পারব এটা। তবে এসব শুনে আমি হাল ছাড়িনি। বরং জেদ বেড়ে গিয়েছিল।"

কীভাবে এগোলেন? "দুটো কথা ভেবেছিলাম। এক, আমার বোনকে তো আর ফিরে পাব না, কিন্তু আর কারও বোন-ভাই বা কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। দুই, আগামীদিনে আমার এই প্রচেষ্টায় মানুষের যাতে উপকার হয়, তেমন কিছু করব। এ লক্ষ্যে স্থির ছিলাম। আমার তিনটি ট্যাক্সি ছিল, বিক্রি করে দিই। আমার স্ত্রী গয়না দিয়ে আমায় সাহায্য করে। একমাত্র ছেলের নামে জীবনবীমা করেছিলাম, ভাঙিয়ে ফেলি। অনেক প্রতিবন্ধকতা, দারিদ্র পেরিয়ে ২০০৮ সালে মারুফা স্মৃতি ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন তৈরি করি।"

kolkata news, কলকাতার খবর স্বপ্নের সেই হাসপাতাল। ছবি সৌজন্যে: সহিদুল লস্কর

ফাউন্ডেশন তো হলো, কিন্তু হাসপাতাল? সহিদুল বললেন, ''তখন আমি অন্যের ট্যাক্সি চালাতাম। ঠিক করলাম, যাত্রীদের থেকে সাহায্য চাইব। ট্যাক্সিতে যাঁরা উঠতেন, তাঁদের বলতাম, কেউ ৫০ টাকা, ১০০ টাকা করে সাহায্য করতেন। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করতে পারেন নি বলে কোনও টাকা দেন নি। সকলকে বলতাম, আশীর্বাদ করবেন, সম্ভব হলে দেখে যাবেন আমি সত্যি বলছি কিনা। অনেকে দেখেও যেতেন হাসপাতাল গড়ার কাজ। তারপর তাঁদের অনেকে সাহায্য করেছেন। ২০০৮ থেকে ২০১৮, এই ১০ বছর ধরে অনেক কষ্টে হাসপাতাল গড়লাম শেষ পর্যন্ত।"

আরও পড়ুন: সাথীকে খোলা আকাশ দিতে চান খুনের আসামী বারুইপুরের বন্দি শংকর

এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বারুইপুরের পুঁড়ি গ্রামে উদ্বোধন হয় মারুফা মেমোরিয়াল হাসপাতালের। উদ্বোধন করেন সৃষ্টি ঘোষ নামের এক তরুণী। সহিদুলের ট্যাক্সির এক যাত্রী। উদ্বোধনে আপনার যাত্রী কেন? সহিদুল বললেন, "খুব মজার ঘটনা। সৃষ্টি আর ওঁর মা একবার আমার ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন। ওঁরা শোনেন আমার কথা। তখন সবে সৃষ্টি চাকরি পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, চাকরির প্রথম বেতন আমাকে দেবেন। তারপর ২৫ হাজার টাকা দেন। তাই ওঁকে দিয়েই উদ্বোধন করাই।"

সহিদুলের হাসপাতালে এখন চলছে মূলত আউটডোর পরিষেবা। বহু চিকিৎসকই বিনামূল্যে চিকিৎসা করছেন। কোন দিন কোন চিকিৎসক আসছেন, তা এলাকায় মাইক দিয়ে আগাম ঘোষণা করা হয়। বহু চিকিৎসকই সহিদুলের কাহিনী শুনে তাঁর হাসপাতালে চিকিৎসা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যত অনটনই থাকুক না কেন, লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাওয়াই এখন জীবনের মূলমন্ত্র সহিদুলের। আগামী দিনে রাজ্য সরকারের তরফে আর্থিক সাহায্য পাবেন বলেও আশাবাদী তিনি।

kolkata news kolkata PM Narendra Modi
Advertisment