২৪শে জুলাই সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দৃশ্যটি তৈরি হয়েছিল সেটি কাউকে অবাক করলেও আসলে অভিপ্রেত এবং কাম্য। ইউনিভার্সিটির অনেকগুলি ক্যান্টিনের একটির পরিচালক গতকাল দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর মারা গেছেন, তাঁর মরদেহ আসছে শববাহক যানে, আর অপেক্ষায় আছে ছোটখাটো একটি জনসমুদ্র।
শোকের এই আকার ঘটতে পারে একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রের অকালমৃত্যুতে। কোনো শিক্ষক বা আধিকারিকের মৃত্যুতে এরকম আকারের শোকের অপেক্ষা তৈরি হয়না, যদি না সেই মানুষটি তাঁর পরিচয়ের গণ্ডি ছাপিয়ে আরো বড় মাত্রা পান। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশনের প্রক্রিয়া চলছে, আগামী বছরগুলিতে ক্যাম্পাস যারা কোলাহলে সরব রাখবেন তাঁরা উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন তাঁদের অভিভাবকরা। তাঁরা কি ভাবছিলেন যে কার মৃত্যুতে ছাত্র-শিক্ষক-আধিকারিক-কর্মচারী এবং অন্যান্য ক্যাম্পাসের বসবাসকারীরা এত শোকস্তব্ধ? এই নতুন ছাত্রদের কারোর পিতা-মাতাও হয়তো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন, তিনি হয়তো জিগ্যেস করলেন, ইউনিভার্সিটির কেউ বললেন – মিলনদার ক্যান্টিনের মিলনদা গতকাল সন্ধ্যেবেলায় মারা গেছেন, ক্যানসার হয়েছিল। অবধারিত, সেই অভিভাবকের স্মৃতিতে হুহু করে ফিরে আসবে প্রাণোচ্ছ্বল শীর্ণ একজন মানুষের নিরবচ্ছিন্ন ছবি, কারণ তিনিও মিলনদাকে চিনতেন। আজকের মেঘাচ্ছন্ন ক্যাম্পাসে আরো শোকস্তব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়লো, আরেকজন স্তব্ধ হয়ে গেলেন, আরেকজন দুদন্ড বাদে নস্টালজিক হয়ে উঠলেন।
যুক্তিটা এখানেই, একজন ছাত্রকে চেনে তার সমসময়, একজন শিক্ষককে তার বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের মানুষজন, কিন্তু মিলনদার পরিচিতিটা যে সবসময়েই তাদের ছাপিয়ে যেতে বাধ্য, প্রায় পাঁচ দশকের মানুষ যে তাকে চিনতেন, এবং সেই চেনায় কোনো বিভাগ বা বর্ষের গণ্ডি যে ছিল না। এমনকি যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নন, যাঁরা আসতেন পরিচিতরা আছে বলে, তাঁরাও যে মিলনদাকে চিনতেন ওই অতগুলো দশক ধরেই। মিলনদার পরিচিতি সময় ও স্থানের চেনা সীমানা ছাড়িয়ে আরেকটু দূরে বিস্তৃত।
ফেসবুকে গত সন্ধ্যে থেকেই স্মৃতিবিহ্বল পোস্টের ধারাবাহিকতা বহমান। এবং সেখানে ‘মিলনদা’ একটা স্থাননাম হয়ে গেছে। মিলনদায় আড্ডার গল্প, বিপ্লবের প্রস্তুতি এবং প্রেমের অবসানের গল্প, মিলনদার ‘চিনি দিয়ে গরম জল’, ‘ঢপের চপ’, ‘আইসড টি’-র গল্প – এইগুলি বারবার আসছে। “ক্লাসের পর মিলনদায় আয়”, “সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মিলনদায় দ্যাখা হচ্ছে”, “আমরা আজ মিলনদায় মিট করছি” (এটা প্রাক্তনীরা বলবেন) – এ আমাদের রোজকার উক্তি ছিল। আমরা তো ‘বিজনের চায়ের কেবিন’ শুনেছি, প্রমোদদার কথা শুনেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের কথা শুনেছি, মিলনদা সেরকমই একজন ব্যক্তির নামের স্থানের নাম হয়ে যাওয়া। মধুর ক্যান্টিনের মধুদা ১৯৭১-এ নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু ‘মিলনদা’-য়ে সেই স্থান থেকে ব্যক্তিটিকে আলাদা করে দেওয়া সম্ভবই না। স্থানের কি আর মৃত্যু ঘটে? ঘটে হয়তো, যদি সেই স্থানের চরিত্র যায় পালটে। ক্যান্টিনের স্থানে যদি একটা বিল্ডিং গড়ে উঠলো – কিন্তু সেই স্থানের মৃত্যুতে কজন কাঁদবেন? আজ এক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রী দেখলাম অঝোরে কাঁদছেন।
১৯৭২-এ ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন মিলনদা। প্রথমে চা-সিঙারা নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে বসতেন শুনেছি। তারপর এক সময়ে অবৈধ বা অযাচিত ভেন্ডার হিসেবে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিতাড়ণের সিদ্ধান্ত নিলে ছাত্ররা রুখে দাঁড়ায়, অচিরেই ক্যাম্পাসের ভেতর প্রবেশ করেন মিলনদা, বৌদি আর তাঁদের সুলভ খাদ্যসামগ্রী। একটি জেনারেটর ঘরে মিলনের ক্যান্টিন, সুবর্ণজয়ন্তী ভবনের বেসমেন্টে মিলনের ক্যান্টিন, অতঃপর পাকাপোক্ত ক্যান্টিনের নামকরণ করা হয় ‘আলাপন’। কিন্তু সেই নাম কি আর চলে? আলাপন থেকে যায় ‘মিলনদা’ হয়ে। এবং এ থেকেই প্রমাণ হয় মিলনদা কোনো স্থাননাম নয়, স্থান তো এদিক ওদিক সরেছে। মিলনদা ব্যক্তির নামই। সেই ব্যক্তির বটবৃক্ষের ছায়ার নাম মিলনদা। একটি ক্যাম্পাসের মূল সুর তো কতবার কতভাবেই স্খলিত হতে পারে; আবার তাকে সমে ফেরানোর জন্য থাকে মিলনদার মুক্তাঞ্চল, সেখানে রাজনীতি নিয়ে বাকবিতণ্ডা হতে পারে, সংঘর্ষ কখনোই হবেনা। মিলনদার চায়ে তৃষ্ণা মিটবে সবার একইরকমভাবে, মিলনদার খাবারের জন্য সবার ক্ষুধার রাজনৈতিক রঙ এক।
এই ব্যক্তি সেই ’৭২ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে আসছেন। অপত্যস্নেহ ছিল প্রভূত, তাই তাঁর ক্যান্টিনে কর্মচারীরা ছিলেন তাঁর স্নেহের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত, নিজের সন্তানরা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, এঁদের প্রতিষ্ঠার দিকটাও তিনি খেয়াল রাখতেন। আমাদের অলসতা এবং কল্পনার অভাব – নইলে ওনার সঙ্গে কথোপকথন রেকর্ড করা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটা ইতিহাস পাওয়া যেত। সেই ইতিহাস দেখার দৃষ্টি খুব কম লোকেরই ছিল, কারণ দৃষ্টি থাকলেও সবাই তো আর সবকিছু দেখতে চাননা যদি ক্ষমতার বিভিন্ন নিগড়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। মিলনদা সে অর্থে ছিলেন ইউনিভার্সিটির প্রান্তে অবস্থিত অথচ মানুষের হৃদয়ের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ – তাঁর দেখা, তাঁর মনে রাখা ভিন্ন জিনিস ছিল।
আগামী কয়েকদিন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উঠোনের মত স্থান নিয়ে, কয়েক বছরের সময় নিয়ে স্মৃতিভারাক্রান্ত থাকবো। কিন্তু – এখানেই মজাটা – সেই ইতিহাস, স্মৃতি, স্থানের গল্পকে নীরবে পৌরোহিত্য করবেন একজন মানুষ; বস্তুত তাঁর সেই উপস্থিতি ছাড়া গল্পগুলো তৈরিই হবেনা। তিনি দেখছেন, এদিকে তিনি শশব্যস্ত এবং অন্যান্য কর্মীদের ব্যস্ত করে তুলছেন, এফিসিয়েন্সির শিক্ষা দিতে গেলে তার ফুটবলের মেটাফর আসে, কথায় এখনো পূর্ববঙ্গের টান, পনির হবে ‘ফনির’, আর রুটি এবং চিলি চিকেনের অদ্ভুত যুগলবন্দী হবে ‘রুটি-সিলি সিকেন’, আঙুলের ভাঁজে টাকার নোট (আমার ধারণা সেগুলি ব্যবহারের জন্য নয়, স্রেফ স্টাইল স্টেটমেন্ট)। এই মানুষটিকে দেখে কখনোই মনে হত না দিনগত পাপক্ষয় করছেন বা জীবিকানির্বাহ করছেন, মনে হত – যতদিন সুস্থ ছিলেন – চুটিয়ে বাঁচছেন একটি তরুণ-তরুণী ভরা বিশ্ববিদ্যালয়ে- যেভাবে তারুণ্য আহরণ করে চুটিয়ে বাঁচার কথা।
মিলনদার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকালের অবসান হইয়া গেল।