কচি বয়সেই স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটত মেয়েটা। সমাজ, পরিবার, গুরুজন কারোর বারণের তোয়াক্কা করেনি। নাচতে চাইলে নাচ, গাইতে চাইলে গান। উড়তে চেয়ে উড়েও যাবে ভেবেছিল। এমন সময়ে বার বার ডানা ছাঁটার চেষ্টা চলল মনীষার। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তায় আবার রক্ষণশীল মুসলমান পরিবার। সেই বাড়ির মেয়ের আবার জেদ থাকতে হয়? তিন বছর ধরে উত্যক্ত করে করে জোর করে বিয়ে করতে চাওয়া পাড়ার ছেলেকে স্বামী হসেবে না মানার জেদ। সমাজের চাপে বিয়ে না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জেদ। প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠা পুরুষের ছুড়ে দেওয়া অ্যাসিডে গলে যাওয়া পুড়ে যাওয়া মুখটা ওড়না দিয়ে না ঢাকার জেদ।
মনীষা পৈলান নামটার পাশে 'অ্যাসিড আক্রান্ত' শব্দটা নিতান্তই বেমানান। ওটা মনীষার পরিচয় নয়। বরং সমাজের বুকে একটা অস্বস্তি ও। উচ্ছল, চনমনে মেয়েটাকে দেখলেই পুরুষতন্ত্রের যেন একটা ভয় হয়- এত কিছু করে, মুখ পুড়িয়ে, একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েও এতটুকু মাথা হেট করানো গেল না? আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল না একটুও?
আরও পড়ুন: আমার দুর্গা: সুবাসিনী মিস্ত্রী
২০১৫ -র অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনায় কতটা বদলেছে জীবন? প্রশ্নের উত্তরে মনীষা বললেন, "মুখ বদলে গেলে সমাজ যে বদলে যায়, এটা দেখে ফেলেছি। সেটা অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। সমাজ এতকিছুর পরেও আমাকেই দোষী করেছে, বলেছে, আমি ছেলেটার কাছে চলে গেলে এমন দশা হতো না। আমি এসব নিয়ে কিছু ভাবিই না। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধে হতো। চোখের সামনে দেখলাম আমার মুখটা পুরো পালটে গেল। রোজ পুরনো ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতাম কতটা বদলে গেলাম। ঘটনার পর পর কিছু বন্ধু সরে গেল। তখন সত্যি চিনতে পারলাম আসল বন্ধু কারা। পুড়ে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত মুখটা ঢাকতে ওড়না নিতাম তখন। মাও সেরকম বলত। একদিন হঠাৎ মনে হল, আমি তো হিজাব পরিনি কোনোদিন, তাহলে এখন কেন পরব ওড়না? আমি চাইতে শুরু করলাম লোকে আমার মুখটা দেখুক। জানুক একটা পুরুষের ভোগের বিষয় হয়ে উঠতে পারিনি বলে কী করা হয়েছিল আমার সঙ্গে।"
আরও পড়ুন: আমার দুর্গা: দ্য উইনার্স
জানতে চেয়েছিলাম, "কীভাবে এত প্রাণবন্ত থাক? ফোনের ওপার থেকে জবাব এল, "আগে থাকতাম না তো, মনমরা থাকতাম খুব। আস্তে আস্তে বুঝলাম, যা কিছু বদল আসছে আমার একার, পৃথিবীর কোথাও কিছু থেমে নেই, আমাকে ছাড়াই যে যার মতো দিব্যি আছে। আমি নিজেকে আটকে রাখছি কেন? সেই আমার খোলস থেকে বেরিয়ে আসা শুরু আবার। বাইরের জগতে পা রাখলাম আবার, মানুষের সঙ্গে মিশলাম। চিকিৎসকদের থেকে খুব সাহায্য পেয়েছি কলকাতায়। পরে বুঝলাম, বাংলার অনেক মেয়ের চেয়ে আমি ভালো জায়গায় আছি। অনেকেই আমার পাশে আছে। আর আমার তো শুধু চামড়াটা নষ্ট হয়েছে, বাকি কিছু তো কেউ বদলাতে পারবে না।"
মনীষা কিন্তু শুধু নিজের লড়াইটা লড়ছে না। ওকে দেখে আমাদের সমাজের কত কত মনীষা একটু একটু করে বুঝতে পারছে যন্ত্রণা পুষে রাখায় মহত্ব নেই, আত্মসম্মান নেই। বরং মনীষার জ্বলে যাওয়া মুখটা, খোবলানো চোখটা মনীষার লজ্জা না। ওটা সমাজের বুকে লেগে থাকা একটা দগদগে ঘা।
দিন পনেরোর দেবীপক্ষ নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা আমাদের, কত আয়োজন। ওদিকে মনীষাদের কিন্তু অস্ত্র ছাড়াই, বাহন ছাড়াই একা লড়ে যেতে হয়। পিতৃ পক্ষেও।