অতিমারি পরিস্থিতি আমূল বদল এনেছেন অনেকের জীবনেই। তেমনই লকডাউন জীবনের ভোল বদল করেছিল অজয়নগরের মৌমিতারও। লকডাউন কালে গিয়েছে চাকরি। সংসারের হাল ধরতে অজয়নগরের মৌমিতা ঠেলা গাড়ি করেই মোমো বিক্রি করতে নামেন। সমাজের বাঁকা নজর এড়িয়ে এ এক হার না মানা লড়াই। সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও সেদিনের সেই স্মৃতি আজও যেন প্রতি মুহূর্তেই তাড়িয়ে বেড়ায় মৌমিতাকে।
ভূগোলে স্নাতক মৌমিতার পক্ষে ‘জার্নিটা’ শুরু করা মোটেও সহজ ছিল না। মেয়ে হয়ে ঠেলা গাড়ি করে মোমো বিক্রি করছেন তা নিয়ে পাড়ার লোকেদের থেকে নানান বিদ্রূপও শুনতে হয়েছে পরিবারকে। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন মৌমিতা। বরাবরই রান্নাটা ভালবাসেন। আর মোমো খেতে ভালবাসেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। এই দুই হাতিয়ারকে সম্বল করেন নামেন জীবন যুদ্ধে। স্বাদ আর মোমোর রকম ভেদ মানুষজনকে মৌমিতার তৈরি মোমো প্রেমে ফেলতে বাধ্য করে। আর সেভাবে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
আজ শহরের বুকে পাঁচটি ‘মোমো চিত্তের’ আউটলেট। আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই আরও ৪ টি আউটলেটের উদ্বোধনের পরিকল্পনা। মহিলাদের কর্মসংস্থানেও গড়েছেন নজির। সবকটি আউটলেট পরিচালনায় মৌমিতা নিয়োগ করেছেন মহিলা কর্মচারী। পেয়েছেন স্বামীর একান্ত সাপোর্ট। হার না মানা লড়াইয়ে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। মোমো বিক্রি করে সরকারী চাকুরের বেতনকে হার মানালেন বিএসসি পাস এই তরুণী।
লকডাউন, অনিশ্চয়তা, বেকারত্বের যন্ত্রণার থেকে বাঁচতে ‘মোমো’ কেই মোক্ষম অস্ত্র করে নিয়েছিলেন সেদিনের মৌমিতা। লক্ষ্য স্থির রেখে কাজটা করে গেছেন আর তাতেই মিলেছে সাফল্য। ঠ্যালা গাড়িতে মোমো ব্যবসা শুরু করে আজ ‘মোমো চিত্তে’-র পাঁচটি আউটলেটের মালিক তিনি।
মৌমিতা বলেন, ‘আর সকলের মত আমারও ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা শেষে একটা সরকারি চাকরি করব, লকডাউন সকলের মত আমার জীবনকে একেবারে বদলে দিয়েছিল। আমাকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। চাকরি করতাম একটি বেসরকারি সংস্থায়, হঠাৎ করেই চলে গেল সেই চাকরি। পথে নেমে ঠ্যালা গাড়ি করে শুরু করলাম মোমো বিক্রি। শুরুতে পুঁজি সেভাবে না থাকায় দোকান ঘর পর্যন্ত ভাড়া নিতে পারিনি। যেহেতু পাড়ার মধ্যে থেকেই ব্যবসা শুরু করি, তাই নানান কথা শুনতে হয়েছে পরিবারকে’।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে তো আমার পড়াশুনাকে নিয়েও খোঁটা দিতে ছাড়েন নি। তবে আমি আমার লক্ষ্যে স্থির ছিলাম। পাশে পেয়েছি আমার পরিবার ও আমার এক সময়ের বেস্ট ফ্রেণ্ড, বর্তমান স্বামীকে। আর পেয়েছি মানুষের ভালবাসা।
মৌমিতার কথায়, ‘রান্নাটা যেহেতু করতে ভালবাসতাম তাই এটাকে নিয়েই এগোতে চেয়েছিলাম। আর মোমোর প্রতি বাঙালির আবেগ ভালবাসায় আরও কিছু বদল আনার চেষ্টা করি। রকমারি হরেক রকমের মোমো নিয়ে আসি মোমোর তালিকায়। মানুষের সেই সব আইটেম ভাল-লাগে, তাদের ভালবাসা, সাপোর্ট আজ আমাকে এক আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। আমি সেই সকল মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ যারা অসময়ে আমার পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে ভরসা জুগিয়ে গেছেন’।
শহর কলকাতায় এই মুহূর্তে পাঁচটি আউটলেট রয়েছে ‘মোমো চিত্তে’-র। মহিলাদের কর্মসংস্থানেও নজির গড়েছেন তিনি। সবকটি আউটলেটের হেঁশেল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মহিলারাই। সমাজে মহিলারা যাতে কিছু একটা করতে পারেন, মহিলাদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যেই এমন ভাবনা মৌমিতার, এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।
‘বাঙালি ব্যবসা করতে পারে না’- চিরাচরিত সমাজের প্রচলিত এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন তিনি। গত ডিসেম্বরই কসবার কাছেই চালু করেছেন একটি আউটলেট। এরপর আরও চার থেকে পাঁচটি আউটলেট খোলার পরিকল্পনা করেছেন মৌমিতা। প্রথম দিনের সেই এক প্লেট মোমোই পরিচিতিই পাল্টে দিয়েছে ‘মোমো মিস্ত্রি’ মৌমিতার।