করোনার প্রকোপে গত কয়েক মাস কার্যত থমকে রয়েছে পৃথিবী। সিনেমাহল, থিয়েটার, গানের অনুষ্ঠান - সমস্তকিছুই বন্ধ। কবে পর্দা উঠবে জানেন না কেউই। সাধারণ দর্শক-শ্রোতার মতো অন্ধকারে রয়েছেন শিল্পীরাও। তার মধ্যেই লকডাউনে ঘরবন্ধি হয়ে থাকা মানুষ একাকীত্ব ভুলতে আশ্রয় খুঁজছেন সঙ্গীতের কাছেই। কেউ ফিরে যাচ্ছেন হারিয়ে যাওয়া দিনের বিখ্যাত গানের দু-এক কলির কাছে, কারও অবলম্বন হাল আমলের সুপারহিট কোনও গান। ঋষি কপুরের দর্দ-এ-দিল-ই হোক অথবা সেলিন ডিওনের রেন্ডিশন বা বাঙালির চিরচেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত- করোনা আতঙ্কের আবহে দেশে দেশে মানুষের হাত ধরছে পছন্দের গান। ভুলিয়ে দিচ্ছে একাকীত্ব আর বন্দীদশার ক্লান্তি, অবসাদ।
সুমিতি অরোরা পেশায় আইনজীবী। লকডাউনের আগে থেকেই নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন এই যুবতী। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বেরচ্ছেন না। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতেরও বালাই নেই। সুমিতির কথায়, "লকডাউনের শুরুর দিনগুলি ছিল অসম্ভব কঠিন। সবকিছু আচমকা থমকে গিয়েছিল যেন। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে কাটবে সময়। একঘেয়ে লাগছিল, কাজে মন বসছিল না। তারপর খানিকটা বাধ্য হয়েই গান শুনতে শুরু করলাম। ম্যাজিকের মতো কাজ হল। ঠিক যেন নিজেকে ফিরে পেলাম।" তরুণী আইনজীবী জানান, নিঃসঙ্গ নিভৃতবাসে তাঁকে সবচেয়ে বেশি শক্তি দিয়েছে এক তুর্কি ডিজের মিউজিক। দিনের পর দিন কার্যত লুপে শুনে গিয়েছেন ওই শিল্পীকে।
মনোবিদদের মতে, শরীর-মন তরতাজা রাখতে সঙ্গীতের জবাব নেই। আমাদের শারীরিক ক্লান্তি, মানসিক অবসাদ, একাকীত্বের অসহ্য একঘেয়েমির অব্যর্থ ওষুধ রয়েছে সঙ্গীতে৷ করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর মানুষ তাই নিজের মতো করে নিজের জন্য সাজিয়ে নিয়েছে সঙ্গীতের ডালি। লকডাউনের জন্য কনসার্ট বন্ধ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঘরবন্দী মানুষ নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন বিকল্প। স্পেন এবং ইটালির বিভিন্ন শহরের বাসিন্দারা সোৎসাহে যোগ দিয়েছেন ব্যালকনি কনসার্টে। দিনের বিভিন্ন সময়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ। কারও হাতে বাদ্যযন্ত্র, কারও সম্বল খালি গলা। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ভেসে যাচ্ছে সুর, গানে গানে মানুষ হাত ধরছেন প্রতিবেশীর। একাকীত্ব ভুলে তৈরি হচ্ছে একসঙ্গে বাঁচার নতুন সংস্কৃতি৷ সেতু হিসাবে কাজ করছে সঙ্গীত।
গত কয়েক মাসে নতুন করে জনপ্রিয় হয়েছে ভার্চুয়াল শো-এর ধারনাটিও। সোস্যাল মিডিয়ায় গান গাইছেন শিল্পীরা। ভিডিও পোস্ট করছেন নিয়মিত। শ্রোতারাও জানাচ্ছেন হাতেগরম প্রতিক্রিয়া। মিউজিশিয়ানদের একাংশের মতে, আগামী পৃথিবীর গানবাজনার অনেকখানি নির্ভর করবে এই ভার্চুয়াল শো-এর উপর।
আমাদের দেশের উঠতি শিল্পী আয়ূশও ভার্চুয়াল শো নিয়ে আশাবাদী। তাঁর কথায়, "লকডাউনের সময় আমি সোস্যাল মিডিয়া আর প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রোতাদের সঙ্গে জুড়ে থাকতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি, আমরা কেউ একা নই। এই খারাপ সময় কেটে যাবেই। আমাদের ভাল থাকার, ভালবাসার ভাষা হল সঙ্গীত। বিজ্ঞান বলে, লম্বা নিঃশ্বাস নিলে আর নিয়ম করে গান শুনলে দেহে অক্সিজেন চলাচল বাড়ে। শরীর, মন শান্ত হয়। ভার্চুয়াল শো এর মাধ্যমে তাই এই ক'মাস নিয়মিত গান শুনিয়েছি আমি৷ আগামীতেও এই রকম অনুষ্ঠান শুনবেন মানুষ। সোস্যাল মিডিয়ায় আরও সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হবে শিল্পী এব দর্শকের।"
লকডাউনে কী গান শুনেছেন মানুষ? তালিকা করা দুঃসাধ্য। এক এক দেশে, এক এক রাজ্যে, এক এক অঞ্চলে এক এক রকম গান সঙ্গ দিয়েছে ঘরবন্দী, নিঃসঙ্গ মানুষকে৷ কেউ শুনেছেন ধ্রুপদী সঙ্গীত, কারও সাউন্ড সিস্টেমে বেজেছে রবীন্দ্রনাথের গান, কারও সঙ্গী হয়েছে পুরনো বা হাল আমলের বাজারচলতি সিনেমার হিট কোনও গান। অনেকে আর্কাইভ ঘেঁটে তুলে এনেছেন দুষ্প্রাপ্য কোনও হারিয়ে যাওয়া গান। ভাগ করে নিয়েছেন সকলের সঙ্গে। একটি অটোমোবাইল কোম্পানিতে কাজ করেন প্রভজোৎ কাঙ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার৷ প্রভজোৎ বলছিলেন, লকডাউনের সময় তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা একটানা বাজিয়ে গিয়েছেন স্পাইডারম্যানের 'সানফ্লাওয়ার'। দিনের পর দিন ঘরবন্দি থাকার সময় তাঁকে অনেকখানি শক্তি জুগিয়েছে, ভরসা দিয়েছে পোস্ট ম্যালনের কণ্ঠস্বর। পিছিয়ে নেই বিশিষ্টরাও। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লিওনেল রিচি বলেছেন, তিনি 'উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড' গানটির আরও একটি রিমেক করবেন। ইতিহাস হয়ে যাওয়া গানটির নতুন ভার্সন উৎসর্গ করবেন কোভিড-১৯ ভাইরাসকে। এদেশেও কি এমন কিছু হবে? উত্তর দেবে সময়।