ধর্মের নামে বিভাজন করে মানুষে মানুষে দেওয়াল তুলে দেওয়া যখন খুব সহজ, সেরকমই অন্ধকার সময়ে পাল্টা হাওয়ার গল্প। শারদোৎসবের খুঁটি পুজো উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিতদের পাত পেড়ে সকালের জল খাবার খাওয়াচ্ছেন যারা, তারা সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। মুদার, জিশান, রেহানরা বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব উদযাপনে শামিল হতে চাইছেন মন থেকে।
শহরের প্রথম সারির পুজোর তালিকায় থাকা দক্ষিণ কলকাতার শিবমন্দিরের পুজো। খুঁটি পুজোতে স্থানীয় লোকজন মিলিয়ে প্রায় শ'দেড়েক লোক হয়েছিল রবিবার সকালে। অতিথিদের ভারী জলখাবারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিজে থেকেই নিয়ে নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা সমাজকর্মী মুদর পাথেরিয়া। লেক টেম্পল রোডে, শিবমন্দিরের পুজো যেখানে হয়, তার ঢিল ছোড়া দূরত্বে তাঁর বাড়ি। নিজের বাড়ি থেকে রাঁধুনিকে দিয়ে রান্না করে নিয়ে এলেন পায়েস। পার্ক সার্কাসের জিশান, রেহান, জুলফিকররা পরিবেশন করলেন নিজে হাতে।
পুজো শুরুর আগেই শিবমন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক পার্থ ঘোষ জানালেন পাড়ার সবাইকে পুজোর কাজে শামিল করার জন্যই এই আয়োজন। বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষদের তৈরি পায়েস তখনও চেখে দেখার সুযোগ হয়নি। পুজো শেষে অবশ্য সবার মুখেই পায়েসের প্রশংসা,- "একেবারে বাঙালিদের মতো স্বাদ হয়েছে যে"।
আয়োজক মুদের তো বলেই ফেললেন, "শুধু এ বছর না, এখন থেকে প্রতি বছর আমাদের তৈরি পায়েস যতক্ষণ না সবাই চেখে দেখবে, খুঁটি পুজো সম্পূর্ণ হবে না"।
কিছুদিন আগে একাধিক ঘটনায় বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি যখন রাজ্য সরকারের তোষণের অভিযোগ উঠেছিল, মুখ খুলেছিলেন এই শহরের সঙ্গে সংযুক্ত একদল বিশিষ্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক। মুদের পাথেরিয়া তাঁদেরই একজন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে তাঁরা জানিয়েছিলেন, গোটা সম্প্রদায় “মর্মাহত এবং স্তম্ভিত”, এবং তাঁর সরকারের তথাকথিত ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ যেন দোষীদের শাস্তির পথে বাধা সৃষ্টি না করে। আবার অপরাধ হলেই যেখানে প্রথম প্রশ্ন ওঠে "অপরাধী কি মুসলিম?", সেই সমাজও তো কাম্য নয়, জানালেন রেহান। বললেন, আজকাল আমার শহর, সারা দেশেই এমন ঘটনা ঘটছে, আমাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে আমরা ভারতীয়, এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। অপরাধের কোনও ধর্ম থাকে না, এটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে"।
অতিথিদের হাতে পায়েসের বাটি তুলে দিতে দিতে জিশান বললেন, "দুনিয়ায় আসলে একটাই ধর্ম আছে, সেটা মনুষ্যত্ব। সব ধর্ম সব সম্প্রদায়ের মানুষ পৃথিবীটাকে আরও একটু সুন্দর করি তুলি না, আসুন"।