দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনা ব্যবহৃত টর্চ থেকে সময়ের হাত ধরে বদলানো ঘড়ি, কী নেই এই বছর একানব্বুইয়ের এই মানুষটির কাছে। কলকাতার বুকে ইতিহাসের শিকড় বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা একাকী মানুষটির রোজনামচার গল্প। নকু দাদু। এই নামেই চেনেন তাঁকে নলিন সরকার স্ট্রিটের গলির মানুষেরা। সেই গলির বাইরে যেখানে কলকাতা ছড়িয়েছে তার নবীন হওয়ার প্রমাণ রঙবাহারি হোর্ডিং ও গ্লোসাইনে, তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন বহু দশক আগে। মেট্রো, উবার, এসি বাসে চড়া বাঙালি যখন ইউটিউব, হটস্টারে মগ্ন, সেইসব সন্ধ্যায় এই প্রবীণ মানুষটি হয়ত শুনছেন তাঁর সংগ্রহের প্রাচীনতম এলপি রেকর্ডটি, যা রেকর্ড হয়েছিল বছর পঞ্চাশেক আগে, বা হয়ত সময়ের ধুলো ঝাড়ছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঘড়ির। দুর্লভ সময়ের জিনিস সংগ্রহ শুধু তাঁর নেশাই নন, বরং সেগুলোর হাত ধরে ইতিহাস অক্টোপাসের মত জড়িয়ে রেখেছে তাঁকে।
১৮ বছর বয়স থেকে স্বপ্ন সংগ্রহ শুরু নকু বাবুর। এরপর পেড়িয়ে গিয়েছে অনেক গুলো বছর। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
উত্তর কলকাতার নলিনী সরকার স্ট্রিট এলাকায় একচিলতে গলিতে এক কামরার একটি ঘরে দীর্ঘ ৭৪ বছর ধরে তিল তিল করে জমানো আছে তাঁর স্বপ্ন। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
স্মৃতির সুতোয় টান পড়লে এই বয়সেও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অতীতের সেই স্বপ্নময় দিনগুলো। ছোটবেলা থেকে শখ ছিল পুরনো দিনের জিনিস সংগ্রহ। এরপর থেকেই ঝোঁক লাগলো 'অ্যান্টিক' জিনিসের প্রতি'। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
আশ্চর্য এই মানুষ। পুরনো আমলের গান বা সিনেমা কে–কবে করেছিলেন, কোন সিনেমায়, কার গাওয়া, কোন মেশিনে কোথায় কিভাবে রেকর্ডিং হয়েছিল— সব কথায় এক নিমেষে এখনও বলে দিতে পারেন চোখ বন্ধ করে। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
সবাই খোঁজে নতুনের গন্ধ। উনি খোঁজেন পুরনো। প্রাচীনত্বের নেশায় যে এভাবে মজে থাকা যায় তা সুশীল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের এক চিলতে ঘরে না ঢুকলে বোঝা যাবে না। টাইম ট্র্যাভেল বা সময় সফর এখনও কল্পবিজ্ঞান। তবে সুশীলবাবুর বাড়িতে গেলে মনে হয় টাইম মেশিনের দরকার হবে না, বরং অতীত নিজেই হাজির হবে আপনার সামনে। অ্যান্টিক জিনিসে ঠাসা ১০ ফিট বাই ১২ ফিট-এর ঘরটা বলে দেয় মানুষের ইচ্ছের কাছে পদানত হয় সবরকম বাধা বিঘ্ন।
আরও ফটোস্টোরি দেখতে ক্লিক করুন: খেরোর খাতা: বাঙালি নববর্ষের অন্যতম সঙ্গীর শেষের শুরু
তাঁর পুরোনো আধো–অন্ধকার ঘরে কী নেই! অজস্র নানা মডেলের শব্দযন্ত্র, অ্যাম্প্লিফায়ার, স্পিকার, রোদঘড়ি, বায়োস্কোপ, দম দেওয়া মুভি ক্যামেরা, পোর্টেবল্ প্রোজেক্টর, পকেট মাইক্রোস্কোপ, জমিদার বাড়ির বৈঠকখানার হ্যাজাক, বিউগল্, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বে ব্যবহৃত বাতি, ১৮৭০ সালের রেলের গার্ডদের ব্যবহৃত হ্যারিকেন ইত্যাদি। সংখ্যায় গুনেও শেষ করা যাবে না। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
আশ্চর্য তাঁর সংগ্রহশালা (Express Photo by: Shashi Ghosh)
সবগুলিই আঠারো ও উনিশ শতকের তৈরি যা এখন দুষ্প্রাপ্যও। অথচ সবই ঝকঝকে–তকতকে! দেখলে মনে হবে হাল আমলের জিনিসপত্র। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
আরও ফটোস্টোরি দেখতে ক্লিক করুন: ইঁটভাটার রোজনামচা: ছবিতে প্রান্তিক মানুষের গল্প
চার ফুট বাই চার ফুট ঘরের একদিকে একফালি তক্তোপোষ। আর সারা ঘর জুড়ে যন্ত্রপাতি। এই এক আশ্চর্য মানুষের অনেক অজানা গল্পের ছবি। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
পরম মমতায় পুরাতনীকে আগলে রেখেছেন এই চিরতরুণ । (Express Photo by: Shashi Ghosh)
এসব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের গল্প শুরুর আগে ঋষিসুলভ পাতলা চেহারা নিয়ে শ্বেতশুভ্র দাড়িতে স্মিত হাসেন নকুদা। (Express Photo by: Shashi Ghosh)
যে বয়সে নতুন জিনিসের জন্য মুখিয়ে থাকে মন‚ সেই ১০ বছর বয়সে বালক নকু খুঁজে বেড়াতেন পুরনো জিনিস। বয়স যত বেড়েছে এই নেশা তত জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর জীবনে। তাঁর জীবনের ব্রহ্মচর্য-গৃহস্থ জীবন-বাণপ্রস্থ-সন্ন্যাস সবকিছু জুড়ে আছে পুরাতনী। উপার্জনের সিংহভাগ গেছে সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবেন বলে। ধ্যান জ্ঞান তপস্যা সব মিলে মিশে গেছে পুরোনো সামগ্রী সংগ্রহে। ঘরময় জুড়ে থাকা সংগ্রহ করা হাবিজাবি শব্দ তরঙ্গ হয়ত বয়ে যায় প্রতিদিন এই মানুষটির যাপনে। চলুন এই প্রবীণ মানুষটির হাত ধরে ভেসে যাই সময় ভেলায়। স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকুন তিনি। এবং বেঁচে থাকুক তার দূর্মুল্য সংগ্রহ।