(নর্মদার তটভূমি ধরে হেঁটেছেন চন্দন বিশ্বাস। তাঁর পদব্রজে এই যাত্রার সম্পূর্ণতার কথা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। যাত্রা শুরুর আগে থেকেই, শুরুর শুরু যখন, সেই পর্যায় থেকেই চন্দন এই ট্রেকিংয়ের বর্ণনা লিখতে শুরু করেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়। সে লেখা শেষ হয়নি, কারণ চন্দন বিশ্বাস অনুপুঙ্খতায় বিশ্বাসী।)
বিজলগাও থেকে বেরিয়ে যাব ছিপানেরের দিকে। সেদিন সকালবেলা বেরোতে পারিনি। দীপক বাবাজি দুপুরের খাবার না খাইয়ে ছাড়বেন না। এইসব মানুষের ভালোবাসা ভোলার নয়। কিন্তু ভালবাসার অত্যাচারও কম সহ্য করতে হয় নি। এই যে রকম সেদিনই বেরোতে বেরোতে বেলা ১২টা হয়ে গেল। বেশ চড়া রোদ। অত চড়া রোদের মধ্যে হাঁটতে সত্যি খুব অসুবিধা হয়। লোটা কম্বল গুছিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। মাত্র এক কিলোমিটার যাওয়ার পরেই পিছন থেকে কেউ একজন ডাকতে শুরু করে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন জোরে সাইকেল চালাতে চালাতে আসছে আমার দিকে। কী ব্যাপার? আগের দিন ধনেশের কাছে শুনেছে আমার ফোনে ইন্টারনেট আছে এবং ইন্টারনেট দিয়ে নাকি পৃথিবীর সমস্ত কিছু করে ফেলা যায়। তার লাগানো নিম গাছের ছবি তুলে নাকি ইন্টারনেটে দিয়ে দিতে হবে। তার সেই আবদার রাখা হল। কোথায় দেবো জানিনা কিন্তু দিতে হবে! বোঝো ঠেলা। আবার এগোতে লাগলাম।
এদিকে রাস্তা বেশ রুক্ষ, তেমন গাছ নেই। মাত্র চারপাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই পড়লো এক নদী। কাকরি নদী। নদীতে তেমন জল নেই। কিন্তু পার হতে গিয়ে ব্যাগসমেত কাদায় পড়লাম। সে এক মহাবিপদ! ভাগ্যিস পাশে ক্ষেতে কাজ করছিলেন কয়েকজন। তাঁরাই ধরে টরে আমাকে তুললেন। নদীর কাদা নদীর জলেই ধুলাম। দেখলাম বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একটি পরিবার দিব্যি নদীটা পার হয়ে গেল। এমনকি সুবেশা ভদ্রমহিলাও তার বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে পার হলেন। আমি বোধহয় একমাত্র আনাড়ি যে সামান্য একটা নদী পার হতে পারে না। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার এগোতে লাগলাম। এক সময় পৌঁছে গেলাম ছিপানের। এখানে রয়েছে একটি নিম্বার্ক আশ্রম অর্থাৎ নিমগাছের আশ্রম। আশ্রমিক মহারাজের নাম সুদাম ব্রহ্মচারী। উনি বাঙালি এবং বাংলা বলার উচ্চারণে বাঙাল টান। সানন্দে থাকতে দিতে রাজি হলেন। কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম উনি দেশভাগের সময় ভারতে এসেছেন। প্রথমে রিফিউজি ক্যাম্পে তারপর শিয়ালদা স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দণ্ডকারণ্যে। উনি রাজি হননি ভারত সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গায় থাকতে। নিজের মতো করেই জায়গা খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে অবশেষে নর্মদা খণ্ডে এই নিম্বার্ক আশ্রম গড়ে তোলেন। প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন এখানে। বাংলার মাটির টান এখনো যায়নি তাই বাংলার মাটিতে যে গাছ হয় সেই সব গাছ উনি ওনার আশ্রম এ লাগানোর চেষ্টা করে চলেছেন নিরন্তর। ঝাউ, কলকি ফুলের গাছ, জবা গাঁদা, পাট, লাউ কুমড়ো সবই লাগিয়েছেন। শুধু একটাই দুঃখ, এখানকার মাটি ভালো নয় বলে কোন ফলের গাছ হয় না। আম জাম কাঁঠাল এইসব কাজ হবে না। উনার অনুরোধে ওখানে থেকে গেলাম দু-তিন দিন। পরদিন সকাল সকাল আমরা দুজনে মিলে আশ্রমের জঙ্গল সাফ করলাম। তারপর প্রচুর গাছের ডাল কেটে কলম তৈরি করে লাগিয়ে দিলাম। ঘটনাচক্রে সেই দিনটা ছিল বাইশে শ্রাবণ। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, যাঁরা আর আমাদের মধ্যে নেই সবার উদ্দেশেই গাছগুলি লাগানো। প্রায় আড়াইশো তিনশো গাছ লাগিয়ে ছিলাম সেদিন। তারপর রান্না হল পাট পাতার ঝোল এবং কুমড়ো ফুলের বড়া ভাজা সঙ্গে ভাত। এই মধ্যপ্রদেশের মধ্যে বসে একদম খাঁটি বাঙালি রান্না খাবো সেটা স্বপ্নেও ভাবি নি।
আরও পড়ুন, পায়ে হেঁটে, ইচ্ছেমত নর্মদা (নবম চরণ)
বেরিয়ে পড়লাম ওখান থেকে, গন্তব্য বুধনি। বুধনিতে সুদাম বাবাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন একটি গোপাল মন্দিরে। সেখানে আমি ভারতবর্ষের কুৎসিততম প্রথা গুলির মধ্যে একটিকে দেখলাম। মন্দিরের পূজারীর একজন সাধনসঙ্গিনী আছেন। একটু পরে বুঝলাম উনি সাধনসঙ্গিনী নন, উনি দেবদাসী। খুব ছোটবেলায় ওনার বাবা মা ওঁকে মন্দিরে রেখে যান। দেবতাকে নিবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নিবেদন নিয়েছেন মন্দিরের পূজারী। এবং ওনার সঙ্গে সারা জীবন ধরে যে ভয়ংকর অন্যায় হয়ে চলেছে সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা ওনার নেই। আমি শুনেছিলাম ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও এখনো নাকি দেবদাসী প্রথা চলছে। কিন্তু চোখের সামনে দেখবো সেটা কখনো ভাবতে পারিনি। ওঁর নাম বৈজয়ন্তী বাই। কী দারুন ব্যবহার! নিজের হাতে রুটি বানিয়ে আমাকে খাইয়ে ছিলেন। মনে থেকে যাবে অনেক দিন।
পরদিন হেঁটে পৌছালাম হোসাঙ্গাবাদ। আসলে হোসাঙ্গাবাদ এবং বুধনি নদীর এপার এবং ওপারের শহর হলেও হেঁটে যেতে গেলে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরত্ব। মাঝখানে যদি একটি ব্রিজ আছে কিন্তু তাতে দূরত্ব কমে না। হোসাঙ্গাবাদে একটি আশ্চর্য জিনিস দেখলাম যেটা আমি আজ অবধি সারা ভারতে কোথাও দেখিনি। সেটা হলো ভাংএর দোকান। ওরকম সরকারিভাবে যে ভাংএর দোকান হতে পারে এই ধারনাটাই আমার ছিল না। হোসাঙ্গাবাদে আমি থাকার জন্য কোন আশ্রম পাইনি বা বলা ভাল কোন আশ্রমে আমাকে থাকতে দেয়নি। তাই একটা হোটেলে ছিলাম, এখানে হোটেলে একা থাকতে দিয়েছিল। অনেকদিন বাদে একটু ননভেজ খেয়ে শান্তির ঘুম দিলাম। পরদিন যেতে হবে বাগলখেরী, প্রায় ২৭ কিলোমিটার রাস্তা।
হেঁটেই বাগলখেরী যাওয়ার পরিকল্পনা হলেও সেটা বাস্তবায়িত হল না। বিজলগাওয়ের সেই দীপক বাবা বাগলখেরীতে এক আশ্রমে কথা বলে রেখেছিলেন। সেই আশ্রম থেকে বারবার ফোন করে কেউ একজন বলছেন যে আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে যাই। আমি কারণটা বুঝছি না। তাড়াতাড়ি যেতে গেলে তো গাড়িতে যেতে হয় আমার তো গাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমি হাটাই শুরু করলাম। যখন পৌঁছনোর পৌঁছাব। অত ভেবে লাভ নেই। গ্রামের মাঝখানে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি এসে পাশে থামল। ড্রাইভার সিটে গেরুয়া বসন পরিহিত এক সন্ন্যাসী। উনি বাগলখেরী আশ্রমের মহারাজ। উনি আর ধৈর্য ধরতে না পেরে আমাকে নিতে চলে এসেছেন। আমার উপরে ওনার এতটা সদয় হওয়ার কারণ কি বুঝলাম না! একটি অতিশয় পুরনো মারুতি এইট হান্ড্রেড গাড়ি। যার পিছনের বা দিকের দরজাটা লাগেনা। একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। পিছনের সিটে একটা বড় তেলের ড্রাম, সম্ভবত পেট্রোলের। এই গাড়ির জন্য তো অত পেট্রোল লাগবে না। তাহলে পেট্রোলের ড্রাম কেন? উনি কি পেট্রোল খান? এই সব সাত-পাঁচ হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে আমি আমার স্যাক ডিকিতে রেখে গাড়িতে উঠে পড়লাম। কপালে যা আছে দেখা যাবে।