Advertisment

পায়ে হেঁটে, ইচ্ছে মত নর্মদা (দ্বাদশ চরণ)

তাহলে ভারতবর্ষ টা আড়াআড়িভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বে হেঁটে ফেলতাম। কিন্তু সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। হওয়া উচিতও নয়, কিছু সাধ অপূর্ণ থাকাই ভাল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

যাত্রা শেষ

(সব যাত্রাই শেষ হয়। কালের নিয়মে। চন্দনের নর্মদাযাত্রাও শেষ হয়েছিল কিছুদিন আগে। সে যাত্রার রেশ আমাদের ছুঁইয়ে থাকছিল তার যাত্রাবিবরণীর মধ্যে দিয়ে। সে বিবরণীর অক্ষর-পংক্তির ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল বৃষ্টির ফোঁটা, শোনা যাচ্ছিল রাতের পাখ-পাখালির ডাক। সে বিবরণী লেখাও শেষ হল।  এই ফুরিয়ে যাওয়া, পরের কোনও যাত্রা শুরু, পরের কোনও বিবরণী শুরুর জন্য়ই।)

Advertisment

প্রবল বৃষ্টিতে আমার হাঁটাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। মান্ডলা থেকে শুধু হেঁটে আর অমরকণ্টক পৌঁছানো সম্ভব না। মাত্র এক দিনে এই পরিখা ঘেরা শহরটার প্রেমে পড়ে গেলাম। গন্ডোয়ানা রাজাদের ফোর্ট দেখেই কেটে গেল গোটা একটা দিন। দেখেছিলাম কি করে সেইসময় জলের ট্যাংক তৈরি হয়েছিল। এবং কি অমানুষিক পরিশ্রমে কপিকল দিয়ে সেই জলের ট্যাংকে জল তোলা হত। কাজগুলো কিন্তু মানবশ্রমিকরাই করতেন। সব দেখে থেকে এগোলাম ডিন্ডোরির দিকে।

publive-image রাস্তায় অনেক জায়গাতেই নর্মদা রুটের ম্যাপ মিলবে (ফোটো- লেখক)

আরও পড়ুন, পায়ে হেঁটে, ইচ্ছেমত নর্মদা (একাদশ চরণ)

দু দিনে পৌঁছে গেলাম ডিন্ডোরি। পার্বত্য এলাকা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে মান্ডলার পর থেকেই। এইরকম অদ্ভুত সুন্দর জঙ্গল খুব কমই দেখেছি এর আগে। মান্ডলার লালাজী বাবলু বর্মন নামের এক ভদ্রলোককে বলে রেখেছিলেন আমার কথা। ডিন্ডোরিতে উনিও অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। প্রবল বর্ষণের মধ্যে আমি পৌঁছাই। যেদিন ওখানে পৌছালাম সেই দিনটা ছিল রাখী পূর্ণিমা। বাবলু বর্মন অত্যন্ত আদর করে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে যান। ওনার স্ত্রী দুই ছেলেমেয়ে এবং উনি, চারজন ওনারা। ধর্মভীরু সাধারণ পরিবার। আমি যাওয়ায় কি খুশি হলেন ওনার স্ত্রী। এলাহি খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করেছেন। ওনার মেয়ে আমাকে রাখি পরাল। রাখী বা ভাইফোঁটা নিয়ে আলাদা কোন আবেগ আমার থাকে না। কিন্তু সেই বাচ্চা মেয়েটির রাখি পরানোর সুখস্মৃতি দীর্ঘদিন মনে থাকবে।

publive-image পথের রাখী

আর দুদিনে লালপুর হয়ে পৌছালাম করঞ্জিয়া। ভীমকুণ্ডও এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। আর এক দিনেই পৌঁছে যাব অমরকন্টক। শেষ করতেই হবে এই ভেবে কোন অভিযানে আমি বেরোই না। কোনরকম এক্সট্রা প্রেশার না দিয়ে সাধারণভাবে এগোতে চাই। শেষ করতে পারলে অবশ্যই খুবই আনন্দ হবে। কিন্তু যদি শেষ না করি তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না, জীবনও শেষ হয়ে যাবে না।

publive-image নর্মদাকুণ্ড (ফোটো- লেখক)

শেষ দিনে খুবই চড়াই এবং বৃষ্টি। তারমধ্যে হল জ্বর। শরীরের শেষ শক্তিটুকুকে ধরে রেখেছিলাম শুধুমাত্র এই শেষদিনের জন্য। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অমরকন্টক পৌছালাম। অনেকেই বলেছিলেন এই জঙ্গলের মধ্যে অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে। তাদের দেখা পাইনি। অমরকন্টকে নর্মদা উৎসে পৌছালাম। উৎস বলে আলাদা করে কোন প্রাকৃতিক ব্যাপার আর নেই। উৎসস্থলটি বাঁধিয়ে বেশ বড় একটি মন্দির তৈরি করে রাখা। নাম নর্মদা কুণ্ড। এখানেই আমি আমার অভিযান শেষ করলাম না। আমি আরও আড়াই কিলোমিটার হেঁটে মাই কি বাগিচা চলে গেলাম। এখানেই নর্মদার সুপ্ত উৎস। যদিও সেই উৎস আর দেখা যায় না। মাই কি বাগিচাতেই শ্যামাচরণ লাহিড়ীর তৈরি ক্রিয়া যোগ আশ্রম রয়েছে। জব্বলপুর থেকে সুনীল পাঠক ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেখানে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আশ্রমটি। শান্তির জায়গা।

publive-image মাই কি বাগিচা (ফোটো- লেখক)

এখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার গেলেই শোন নদীর উৎসস্থল। গেলাম সেখানেও। শেষ যখন হয়ে গেছে তখন আর ভেবে লাভ নেই, ভালো করে ঘুরে সব দেখে নিলাম। শোন নদী ভারতবর্ষের অন্যতম পূর্ববাহিনী নদী। অমরকণ্টকের মাই কি বাগিচা থেকে শুরু হয়ে পাটনার কাছে গঙ্গাতে গিয়ে মিশেছে। হাতে যদি আরো কিছুদিন সময় থাকত তাহলে শোন নদীর পাড় দিয়েও হাঁটা যেত। তাহলে ভারতবর্ষ টা আড়াআড়িভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বে হেঁটে ফেলতাম। কিন্তু সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। হওয়া উচিতও নয়, কিছু সাধ অপূর্ণ থাকাই ভাল।

travelogue
Advertisment