Advertisment

পায়ে হেঁটে, ইচ্ছে মত নর্মদা (চতুর্থ চরণ)

এখন বুক পর্যন্ত জল। এমনিতে পার হওয়াই যেত, কিন্তু সঙ্গে রয়েছে ১৭ কিলোর ভারী স্যাক। জলে পড়লেই সাড়ে সর্বনাশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

গ্রামের মানুষ কেউ এল না নদী পার হতে। (ফোটো- লেখক)

(সাইক্লিস্ট চন্দন বিশ্বাস হাঁটছেন নর্মদার তটভূমি ধরে। থ্রিলিং সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য, রাস্তা থেকে)

Advertisment

সকালে বেরিয়ে পড়লাম বাদাবনের মণিনাগেশ্বর মহাদেব মন্দির থেকে। অভিযানের প্রথম দিন থেকেই বৃষ্টি চলছে। বেরোনোর সময়ই বিপত্তি। সকাল ৬টায় ব্যাগপত্তর বাঁধাছাদা করে হাঁটার জন্য রেডী, কিন্তু ধুম বৃষ্টি! শেষমেষ বেরোতে পারলাম সকাল ন’টায়। পায়ে চলা রাস্তা, রাস্তার দুইপাশ দিয়ে নিম গাছের সারি। নিমপাতা চিবোতে চিবোতে হাঁটছি। অল্প বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। কিলোমিটার দশেক চলার পর একটি গাছের তলা দেখে থামলাম একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন মোটরবাইক নিয়ে। খুবই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করে চলেছেন। হাজারো জিজ্ঞাসা রয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। আমিই পরিচয় দিলাম নিজের। খুব খুশী হলেন না। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বোঝা গেল।

ওঁর নাম চন্দ্রকান্ত দিওসাওয়ানা। স্থানীয় লোক, উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। পুরোপুরি নাস্তিক। হিন্দুধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের ঘোর বিরোধী। এবং বর্ণহিন্দুদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিপীড়িত। তাই আমার নর্মদা অভিযানের কথা শুনে ধরেই নিয়েছিলেন যে ধর্মীয় কোন যাত্রা হবে বোধহয়, তাই প্রথমে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু এখন পুরোটা শুনে সাংঘাতিক আগ্রহ দেখালেন। ব্যাস আর কি? উনিও হাঁটতে শুরু করে দিলেন আমার সঙ্গে। দারুন এক অভিজ্ঞতা। চলতে থাকল আলোচনা। ভাঙা হিন্দি এবং গুজরাটি মেশানো ভাষায়। চার উপজাতি সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন। বিভিন্নভাবেই তারা বঞ্চনার শিকার তারা। খুব খারাপ লাগছিল শুনে। সারাভারতে এমন একটাও জায়গা নেই যেখানে প্রান্তিক মানুষেরা ভালো আছেন।

গুগল ম্যাপট্যাপ দেখে গন্তব্য ঠিক করেছি ‘নাভরা’ নামের একটি জায়গায়। রাতে থাকার মত বেশ কয়েকটি আশ্রম আছে দেখে নিয়েছি। উনি হঠাৎ করেই বললেন,

-’চলুন একটা শর্টকাট নেওয়া যাক।’

publive-image ওঁর নাম চন্দ্রকান্ত দিওসাওয়ানা।

গ্রামের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। গ্রামের মানুষজন সবাই ওনাকে চেনেন। বুঝলাম বেশ নেতাগোছের লোক। এক বাড়িতে জল খাওয়ার জন্যেও বসলাম অনেকক্ষণ। আর একটু এগোতে গিয়েই পড়ল একটা ছোট নদী। কিন্তু বেশ জল। মাথায় হাত! এটা কিন্তু ম্যাপে কোথাও ছিল না। চন্দ্রকান্তবাবুও একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ এই নদীতে নাকি এত জল থাকে না, তাই এই রাস্তায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন বুক পর্যন্ত জল। এমনিতে পার হওয়াই যেত, কিন্তু সঙ্গে রয়েছে ১৭ কিলোর ভারী স্যাক। জলে পড়লেই সাড়ে সর্বনাশ। উনি অভয় দিলেন যে নিশ্চই গ্রামের মানুষ কেউ পার হবেন। তখন সবাই মিলে ব্যাগ পার করে দিলেই হবে। বেশ, তাই হোক! কিন্তু শুধু মুখে তো অপেক্ষা করে লাভ নেই। বিশেষত সঙ্গের স্যাকে যখন চা-চিনি স্টোভ রয়েছে।

publive-image উনিও হাঁটতে শুরু করে দিলেন আমার সঙ্গে। (ফোটো- লেখক)

চা খাওয়াও হল, আড্ডাও হল, কিন্তু গ্রামের মানুষ কেউ এল না নদী পার হতে। অগত্যা আমরা দুজনেই নামলাম জলে। ধরাধরি করে খুব সাবধানে পার হলাম। নদীপার করিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন উনি। মাত্র তিন চারঘন্টার পরিচয় এবং আলাপ। কিন্তু সারাজীবন মনে থেকে যাবেন সেই নিঃস্বার্থ মানুষটি। আমি এগোলাম আমার মত।  হাঁটতে হাঁটতে নাভরা এসে গেল। ১৭ই জুলাই ২০১৮ আমি নাভরা কার্তিকস্বামী আশ্রমে এসে পৌঁছলাম। আশ্রমে ঢোকার মুখে তিন-চারজন বাবাজী কষে গাঁজায় দম লাগাচ্ছেন। আমায় দেখে বিকট জোরে ‘হরিওম হরিওম’ হুঙ্কার দিতে শুরু করলেন। একটু হকচকিয়ে গেলুম। আমায় দেখে এত আনন্দ হওয়ার কারণ কী? একটু পরেই বুঝলাম সবই শিবের প্রসাদের ফল।

publive-image নদীপার করিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন উনি। (ফোটো- লেখক)

(আমি বর্তমানে ওমকারেশ্বর পৌঁছেছি, থাকার সামান্য সমস্যা হওয়ায় এই সংখ্যায় খুব বেশী লেখা সম্ভব হল না। কথা দিচ্ছি আগামী পর্বে পুষিয়ে দেব।)

travelogue
Advertisment