(সাইক্লিস্ট চন্দন বিশ্বাস এবার বেরিয়ে পড়েছেন পায়ে হেঁটে। তাঁর নর্মদাযাত্রার অভিজ্ঞতা শুরু থেকেই লিখে চলেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার পোর্টালে।)
কার্তিক স্বামী আশ্রম বেশ বড় একটি আশ্রম। কিন্তু এটা ঠিক তথাকথিত নিয়মনীতি মেনে চলা আশ্রম নয়। সাধারণ গরীবলোকের আশ্রম। ফলে সারাদিন লোকজনের আসাযাওয়া লেগেই আছে। বেশ মজায় দুদিন থাকলাম ওখানে। ওখানেই পরিচয় হল অনিল দাস ত্যাগীর সঙ্গে। আমারই বয়সী একজন ‘প্রায়’ সাধু। বাড়ি মথুরায়। ওখানে একজন বাবাজীর আশ্রমে স্টোরকিপারের কাজ করতেন। ইচ্ছে হয়েছিল নর্মদা পরিক্রমা করার। সঞ্চয় ছিল ২,০৬০ টাকা। বাবাজীর কাছে গিয়ে অনুমতি চাওয়াতে বাবাজী সঞ্চয়ের থেকে ২,০০০ টাকা নিয়ে নিয়েছেন। বাকি ৬০ টাকা দিয়ে বলেছেন, পরিক্রমা করতে হলে এই ৬০ টাকাতেই করতে হবে। ব্যাস! গুরুর আদেশ মাথায় নিয়ে অনিলবাবু বেরিয়ে পড়লেন। প্রায় ন’মাস হয়ে গেল অমরকণ্টক থেকে যাত্রা শুরু করেছেন। ৬০ টাকাতেই চলছে এখনও। অনিলবাবুর নাম হয়ে গেছে ‘ষাট রূপায়ওয়ালা বাবা’। মজাতেই আছেন। কবে পরিক্রমা শেষ করবেন জানেন না। আরও পরিচয় হল ‘ল্যাংড়া ত্যাগী’র সঙ্গে। এক পা সামান্য পঙ্গু। কার্তিক স্বামী আশ্রমের কুক। সত্যিই ওনার নাম এখন ল্যাংড়া ত্যাগী, আসল নাম বলতে রাজি হলেন না। ছয়বার নর্মদা পরিক্রমা করেছেন। একবার সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছিলেন, কোনোমতে বেঁচে ফিরেছেন। আর একবার পরিক্রমা করবেন। দুজনের সঙ্গেই দারুন আড্ডা জমে গেল। পরবর্তী রাস্তার রুট গাইড করে দিলেন অনেকটাই। আমিও খানিক ঋদ্ধ হলাম।
ভেবেছিলাম দুএকদিন থেকে যাব ওখানে কিন্তু আমি ইতিমধ্যেই কিছুটা পিছিয়ে আছি আমার টাইমলাইন থেকে। তাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। বেরোতেই হল পরদিন। বেরোতেই প্রথমে পড়ল শিসদরা গ্রাম। সেখানকার একজন ভদ্রলোক ধরে বাড়ি নিয়ে চলে গেলেন, নাম উমঙ দোশী, পেশায় দর্জি। কোনো কারণ ছাড়াই চা এবং সকালের জলখাবার খাইয়ে দিলেন। বেশ মজার লাগে এই অভিজ্ঞতাগুলি। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের সাহায্য ছাড়া এই অভিযান সম্পূর্ণ নয়। প্রায় ৩০ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছলাম নারকন্ডি গ্রামে। ওখানে এক নালেশ্বর মহাদেব মন্দিরে কোনোমতে রাত কাটালাম। নিজেই ম্যাগি বানিয়ে খেলাম।
পরদিন বেরিয়ে পড়লাম মহাদেব মন্দির থেকে, গন্তব্য ঠিক করেছি মাংরোল নামের গ্রামে। ম্যাপে দেখে নিয়েছি ওখানে একটা তপোবন আশ্রম আছে। সারাদিন হনটনপর্ব সেরে ওখানেই থাকব ঠিক করেছি। হাঁটছি, সাধারণ গ্রামের রাস্তা। নদীর তট ধরে হাঁটার কোনো অপশন নেই। রাস্তাই নেই ওইদিকে। বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মাংরোল গ্রামে। একটা দ্বিধাধন্দের মধ্যে পড়লাম। পাশাপাশি দুটি আশ্রম। তপোবন আশ্রম এবং রামানন্দ আশ্রম। কোন আশ্রমে থাকি? টস করে ঢুকে পড়লাম তপোবন আশ্রমে। বেশ বড়লোক আশ্রম, কার্তিক স্বামী আশ্রমের মত সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই অতটাও। এই ধরনের আশ্রমে থাকতে খুব ভালো লাগে না। যাই হোক, ঢুকে যখন পড়েছি তখন কি আর করা যাবে। দায়িত্বে যে বাবাজী আছেন তিনি কিন্তু বেশ ভালো। সানন্দে থাকতে দিতে রাজী হলেন আমায়। এক প্রকান্ড হলঘরে আমি একা। বেডিংপত্তর (বেডিং বলতে শুধুই ম্যাট্রেস) পেতে রাখলাম। কিন্তু এদিকে আরেক বিপত্তি। আশ্রমের প্রধান যে বাবাজী আছেন তার সম্ভবত মাথা সামান্য খারাপ। সামান্য কেন, পুরোই খারাপ। তিনি তার ভক্তদের দর্শন দেন রাত দুটোর সময়। কী কাণ্ড! ভক্তদের মাথা আরোই বেশী খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। নইলে তারাই বা রাত দুটোর সময় বাবাজীর দর্শন নেওয়ার জন্য আসেন কেন?
আরও পড়ুন, পায়ে হেঁটে, ইচ্ছে মত নর্মদা (চতুর্থ চরণ)
এইসব পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখেশুনে পরদিন সক্কাল সক্কাল পালালাম তপোবন আশ্রম থেকে। আজ যাব ঠিক করেছি গওর গ্রামে। গত কয়েকদিন ধরেই বিরক্তি বাড়ছিল ধীরে ধীরে তার প্রধান কারণ নর্মদার তট ধরে হাঁটার কোনো রাস্তা নেই। যে উদ্দেশ্য নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছি তার মূল কাজটাই হচ্ছে না। কি আর করা যাবে। সারাদিন হেঁটেহেঁটে পৌঁছালাম গওর। এখানেও রয়েছে এক রামানন্দ সন্ত আশ্রম। থাকার ব্যবস্থা সেখানেই। সেখানে পৌঁছে নতুন এক অভিজ্ঞতা হল। একজন ২০-২১ বয়সের ছেলেকে তার বাবা-মা পাঠিয়ে দিয়েছেন এই আশ্রমে। ভক্তদের সেবা করার করার জন্যে। ছেলেটির একদমই থাকার ইচ্ছে নেই, কিন্তু বাবামায়ের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না। আমি তো বাবামায়ের আক্কেল দেখে পুরোই হা হয়ে গেলাম। কিন্তু এখানে আমার কিছু করার নেই। শুধুই দেখে যাওয়া কাজ।
ওখান থেকে বেরিয়ে আজ যাব গোরাকলোনি। এরকম আশ্চর্য নাম কেন সেটার জন্য আগ্রহ ছিল খুব। কিন্তু জায়গায় পৌঁছে অনেক অনুসন্ধান করেও খুঁজে পেলাম না কিছুই। যাইহোক গোরাকলোনিতে প্রথম যে আশ্রমে গেলাম সেটার নাম আনন্দ আশ্রম। এটা শুধুমাত্র আশ্রম নয়, এখানে ছেলেদের একটা হোস্টেলও আছে। আমি খুবই আনন্দ পেলাম ব্যবস্থা দেখে। প্রধান অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বললাম থাকার ব্যাপারে। কিন্তু তিনি নারাজ আমাকে থাকতে দিতে। কেন তার কারণ জানালেন না। আমি আর খুব বেশী অনুরোধ করিনি। একটু খারাপ লাগলেও মেনে নিলাম। সব জায়গায় আশ্রয় যে পাবই এই ধারণা করাটাই ভুল। ‘ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’ - এই ভেবেই তো বেরিয়েছি। অন্য আশ্রয় খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। নামল বৃষ্টি। বৃষ্টি কিন্তু অভিযান শুরুর দিন থেকে লেগেই চলেছে। তাতে কিন্তু কোনও অসুবিধা হচ্ছে না আমার। বরং ওয়েদার ঠান্ডা থাকছে, হাঁটতে সুবিধা হচ্ছে। গ্রামের একজনের বাড়িতে ঢুকে খানিক খোশগল্প করে নিলাম। এইগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ইদানিং। আরেকটি আশ্রম খুঁজে বার করলাম, হরিধাম আশ্রম। বাবাজীর নাম ‘বটুক মহারাজ’। খুব ভালো ব্যবস্থা নয়। প্রকাণ্ড এক হলঘরে গণ থাকার ব্যবস্থা। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। যাইহোক একটা রাতই তো থাকব।
হরিধাম আশ্রম নর্মদার একদম তীরে। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যে নর্মদায় কোনো জল নেই। একেবারেই শুকনো। কারণ একটু দূরেই রয়েছে সর্দার সরোবর ড্যাম। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নামে। এতদিন হাঁটছিলাম নর্মদার দক্ষিণতট ধরে। এবার পেরিয়ে যাব উত্তরতটে। পেরিয়ে ১৫ কিলোমিটার গেলেই রয়েছে গড়ুরেশ্বর। পৌঁছে গেলাম ২২শে জুলাই। এতদিন বাদে পেলাম একটা ধরমশালা। প্রথমেই একটা রুম বুক করে নিলাম দুদিনের জন্য। আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম ৫-৬ দিন পরপর একদিন রেস্ট নেব, জামাকাপড় কাচারও ব্যাপার আছে। প্রথমেই সেটা সেরে নিলাম। গড়ুরেশ্বেরের আর একটা মজার ব্যাপার হল এখানে ননভেজ পাওয়া যায়। আমি মাছমাংস খাওয়া পাতি বাঙালি, আমার কি আর অত নিরামিষ পোষায়? পেট ভরে খেলাম। আর একটা জিনিস এখানে একটু অন্যরকম। বাংলায় যেমন ভুট্টা পুড়িয়ে বিক্রি হয়, এখানে আস্ত ভুট্টা সেদ্ধ করে। খুব খারাপ লাগে না খেতে। পরদিন বেরোলাম এখানকার প্রধান আকর্ষণ সর্দার সরোবর ড্যাম দেখতে। প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে, কিন্তু কোন বাস বা শেয়ার গাড়ি যাবে না। তাতে যাওয়া আটকাবে না। লোকের মোটরবাইকে লিফট নিয়ে পৌঁছে গেলাম ড্যামের কাছাকাছি। কিন্তু যাওয়ার রাস্তাতেই কান্ড দেখে মাথা গরম হয়ে গেল। নর্মদা নদীর ঠিক মাঝখানেই গুজরাট সরকার বল্লভভাই প্যাটেলের একটা স্ট্যাচু বানাচ্ছে। তার আবার গর্ব করে নাম দিয়েছে ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’। অত্যন্ত কুৎসিত ব্যাপার। খুব বেশী বুদ্ধি থাকা লাগবে না, সামান্য বুদ্ধি বিবেচনাওয়ালা যেকোনো মানুষই বুঝতে পারবেন কী ভুল হতে চলেছে। আর ড্যাম দেখার ইচ্ছেটাই থাকল না। সামান্য ঘুরে ফিরে এলাম ধরমশালায়।
এবার সামনে পড়বে শূলপাণেশ্বর জঙ্গল। প্রচুর কুখ্যাতি শুনেছি। দেখা যাক কী হয়।