(নয় নয় করে এগারো সপ্তাহ ধরে নর্মদা যাত্রার বিবরণী লিখে ফেলেছেন চন্দন বিশ্বাস। তাঁর দেখার চোখ ও লেখার মুন্সিয়ানা, দুয়ে মিলে পাঠক-পাঠিকারা পৌঁছে গেছেন এই যাত্রাপথে। তবে এ যাত্রা তো অনন্ত নয়, তেমনই এ লেখাও নয় অসীম। চন্দন পথের প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। আগামী সংখ্যায় এ বিবরণমালা শেষ হবে। পরের যাত্রা শুরুর জন্য)
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম বাগলখেরী। অন্যান্য আশ্রম গুলোর মতন এই আশ্রমটা নর্মদা নদীর তীরে নয়। নদী এখান থেকে প্রায় দু তিন কিলোমিটার। বাবাজি এখানে একাই থাকেন। বেশ আধুনিক বাবাজি। একটি রয়াল এনফিল্ড বুলেট নিয়ে চলাফেরা করতেন এতদিন। হাঁটুর ব্যথায় আর মোটরবাইক চালাতে পারেন না। তাই এখন গাড়ি ব্যবহার করছেন, নিজেই চালান। ইনিও কিন্তু বাঙালি। গত কয়েক দিনে নর্মদা তীরে এত বাঙালি সাধু বাবা দেখে আমি বেশ অবাক। সেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে এত দূরে এসে নিজের মাহাত্ম্য কায়েম করা বেশ কঠিন ব্যাপার! যথেষ্ট অধ্যাবসায় না থাকলে সম্ভব না। এখন চতুরমাস চলার কারণে কোন পরিক্রমাবাসী নেই। তাই আমি আসায় একজন সঙ্গী পেলেন। গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে জঙ্গলের মধ্যে বেশ বড় দোতলা আশ্রম তৈরি করেছেন। সামনে একটা ছোট বাগান এবং সবজির খেত। বাবাজির সেবা করার জন্য গ্রামের মধ্য থেকে দুএকজন আসতেই থাকেন। মহারাষ্ট্রের আরেকজন বাবাজিও বর্তমানে আছেন। তার মাথা সামান্য খারাপ মনে হচ্ছে। বাগানের কাজ কর্ম তিনিই করেন। মাথা সামান্য খারাপ এই কারমে বললাম যে বৃষ্টি হোক বা না হোক উনি গাছে জল দেবেন। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে তার মধ্যে উনি ছাতা মাথায় দিয়ে গাছে জল দিচ্ছেন। আমি একটু বলার চেষ্টা করলাম এই বৃষ্টির মধ্যে গাছে জল দেওয়ার দরকার নেই পাগল বাবা ইশারায় বারণ করলেন কিছু বলতে! এই পৃথিবীতে যে যার তালে থাকে। কাউকে কোনো কাজে বাধা দিতে নেই।
পরদিন আর বেরোলাম না ওখানেই থেকে গেলাম। বিকালে ওনার সঙ্গে গেলাম স্থানীয় বাজারে। এই বাবাজিকে সবাই বেশ পছন্দ করে দেখলাম। কেনাকাটি করার সময় টাকা-পয়সার কোন ব্যাপার নেই। প্রত্যেক দোকানে দু-চার মিনিট কথা বললেই হল, ব্যাগের মধ্যে কিছু না কিছু ঢুকিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতা। এরকম বাজার করে মজা আছে। বাবাজির কিন্তু পেঁয়াজ রসুন মাছ-মাংস খাওয়া নিয়ে কোনো ধরনের আপত্তি নেই। আশ্রমের পিয়াজ রসুনটা চলে, কিন্তু মাছ মাংসটা চলে না। ওটা বাইরে ভক্তদের বাড়ি গেলে খান। বাবাজী কোনো নিয়মের মধ্যে বাঁধা থাকতে পছন্দ করেন না। আমারই মত। সমস্যাটা শুরু হল রাত্রে বেলা। রাত দুটোয় ঘুম থেকে তুলে দিলেন। কি ব্যাপার না ওনার হঠাৎ করে মনে হয়েছে ঘরের মধ্যে কুকুর ঢুকেছে। এবার খোঁজো! আমি ঘুম চোখে বললাম যে দরজা তো বন্ধ, কুকুর ঢুকবে কোথা দিয়ে? আমার কথায় পাত্তা দেওয়া হল না। রাত দুটোয় সবাই মিলে খাটের তলায় আলমারির পিছনে টয়লেটে কুকুর খোঁজা হচ্ছে। যথারীতি কিছু পাওয়া গেল না। তিনটে নাগাদ আবার শোওয়ার তোড়জোড় করলাম। উনি শুরু করলেন মন্ত্র পাঠ। অত্যন্ত পরিষ্কার উচ্চারণ। ঘুমের অসুবিধা হলো না। এতদিন নর্মদা তীরে তন্ত্র-মন্ত্রের মধ্যেই রয়েছি। হয়তো খানিকটা অভ্যেস হয়ে গেছে। ওঁর মন্ত্রপাঠ অনুঘটকের কাজই করল।
অনেক জায়গাতেই ইচ্ছা করে থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তো চিরস্থায়ী ভাবে থাকার জন্য আসিনি। এগিয়ে যাওয়াটাই লক্ষ্য। ধীরে ধীরে বর্মন ঘাট পেরিয়ে এগিয়ে চললাম জব্বলপুরের দিকে। এতদিন রয়েছি নর্মদার দক্ষিণ তটে। জব্বলপুর উত্তরে। নদী পেরিয়ে জব্বলপুররের ঢোকার মুখেই নামল বৃষ্টি। একজনের বাইকে লিফট নিয়ে জব্বলপুর স্টেশনের কাছাকাছি পৌছালাম। জব্বলপুরে আমার কোন চিন্তা ছিল না। জব্বলপুর রয়েছে আমার এক বন্ধু স্বপ্নিল তিওয়ারি। সে এক এলাহি ব্যবস্থা করেছে আমার থাকার জন্য। জব্বলপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউস। সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসটির নাম কৃষি নগর। এরকম উপযুক্ত নাম আজ পর্যন্ত শুনিনি। জব্বলপুরের জন্য বেশ লম্বা-চওড়া প্ল্যান ছিল। ভেবেছিলাম দু তিনদিন থেকে জব্বলপুরের দর্শনীয় জায়গাগুলো খুব ভালো করে ঘুরব। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে সেই প্ল্যান ভেস্তে গেল। তার বদলে আলাপ পরিচয় হলো জব্বলপুর রোটারি ক্লাবের পুরো টিমের সঙ্গে। তারা একটি সংবর্ধনা দিলেন আমাকে। জব্বলপুর থেকে অমরকণ্টক আর খুব বেশিদিন নয়। বাকি দিনগুলোতে থাকা খাওয়ার দায়িত্ব নিলেন তারা।
জব্বলপুর একটু সময় নষ্ট হলেও পরবর্তী রাস্তায় একটু চেনা পরিচিত পাওয়া গেল, তার ফলে সুবিধাই হলো। এতদিনে পুরো বর্ষা চলে এসেছে। হেঁটে পরবর্তী পুরো রাস্তা যাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। খানিকটা গাড়ি খানিকটা হেঁটে নারায়ণগঞ্জ পৌছালাম। কোন বড় আশ্রম বা মন্দির চোখে না পড়ায় খানিক হেঁটে গ্রামের মধ্যে চলে গিয়ে এক পুরোনো ভাঙা রাম মন্দিরে রাত কাটালাম। পরদিন পৌছালাম মান্ডলা। এখানে নর্মদার সঙ্গে মিশেছে তার উপনদী বাঞ্জার। এখানেই পেয়ে গেলাম লালাজিকে। উনি একজন নর্মদা বিশারদ। সব জায়গায় যদি ওঁর মত একজন নর্মদা বিশারদকে পেয়ে যেতাম তাহলে আমার গবেষণা আরও মসৃণ হত। মান্ডলা একটা পুরনো ঐতিহাসিক শহর। গোন্ডওয়ানা রাজপরিবারের রাজত্ব ছিল এই অঞ্চলে। মান্ডলা শহরটি অনেকটা বাংলা ‘ব’ অক্ষরের মত। নর্মদা নদী পরিখার মত শহরটি কে ঘিরে রয়েছে। সাধারণত নদীর দুই তীরেই যদি শহর থাকে তাহলে তাদের নাম আলাদা হয়। কিন্তু এখানে নর্মদার উভয় প্রান্তের শহরের নামই মান্ডলা। মজাদার জায়গা।
নর্মদা তীরে প্রচুর ঘাট রয়েছে। এবং এখানে সামাজিক শ্রেণী বিভাগ অনুযায়ী প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ঘাট। খাজাঞ্চি ঘাট, হনুমান ঘাট, সাহেব ঘাট এমনকি জেলের কয়েদিদের জন্য জেল ঘাটও আছে। কয়েদিদের পুণ্যার্থে ব্রিটিশ সরকারের ব্যবস্থা। কয়েদিদের পুণ্য করানোর জন্য তাদের চিন্তার শেষ ছিল না। মান্ডলাতেই নগর উন্নয়ন পরিষদের উদ্যোগে একটি পুরাতত্ত্বের সংগ্রহশালা আছে। বহু প্রাচীন কিছু ফসিলস সেখানে রেখে দেওয়া আছে। এছাড়া রয়েছে একটি সহস্রধারা। সারা ভারতবর্ষে প্রায় সাত আটটি সহস্রধারা আছে। সাধারণত কোন ঝর্ণা বা নদীর উৎপত্তি যদি বহু ছোট ছোট ধারা হয় তখন তাকে সহস্রধারা বলে। এবং স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সব কটি সহস্রধারার চরিত্র আলাদা। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। আরেকটি জিনিস বেশ ভালো লাগল, এখানেই নর্মদার তীরে নদীর দূষণ মাত্রার একটি বোর্ড লাগানো আছে এবং সেটি নিয়মিত আপডেট করা হত। অর্থাৎ নদীর জলে কতটা ক্লোরাইড, কতটা ফ্লোরাইড, কতটা নাইট্রেট, পিএইচ ভ্যালু কত - সব লেখা হত। নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী প্রজেক্ট। কিন্তু কেন বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেল সেটা জানা গেল না।