Advertisment

পায়ে হেঁটে, ইচ্ছেমতো নর্মদা (ষষ্ঠ চরণ)

শূলপাণেশ্বরের জঙ্গলে মূলত ভিল উপজাতির মানুষেরা থাকতেন। যখন সর্দার সরোবর ড্যাম তৈরি হয় তখন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কিছু কিছু পরিবারকে সামান্য ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

হাফেশ্বরের নর্মদা (ফোটো- লেখক)

(নর্মদার তটভূমি ধরে হেঁটে চলেছেন চন্দন বিশ্বাস। বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ জমে উঠছে তাঁর, বহুরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন তিনি। রাস্তা থেকে লেখা ও ছবি পাঠাচ্ছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য)

Advertisment

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নামাঙ্কিত সর্দার সরোবর ড্যাম গড়ে উঠেছে শূলপানেশ্বর জঙ্গলের মধ্যেই। গড়ুরেশ্বর থেকে শূলপানেশ্বর জঙ্গলে ঢোকার সরাসরি কোনো রাস্তাই নেই। সেই কলকাতা থেকে বেরোনোর আগে থেকে গুগল ম্যাপ, ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের ম্যাপ সব ঘাঁটাঘাঁটি করছি যদি একটা ঢোকার রাস্তা পাওয়া যায়। কিছু পাইনি। গড়ুরেশ্বরে এসেই সোজা হানা দিলাম ডিসি অফিসে। যদি মাননীয় ডিসিসাহেব কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। নাহ, কোনো উপায় নেই। উনিও হাত তুলে দিলেন। সর্দার সরোবর ড্যামের কারণে সম্পূর্ণ এলাকাটি অতিরিক্ত নিরাপত্তায় মোড়া। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ অনুমতি ছাড়া ঢোকা প্রায় অসম্ভব। খুব হতাশ হলাম না। লালফিতের ফাঁস ডজ করতে করতেই তো এতবছর অভিযান চালিয়েছি। ম্যানেজ করতে হয় সবই। ভারতবর্ষের জঙ্গলগুলি বর্ষাকালের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এই তিনমাস পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ থাকে। জঙ্গলের বাসিন্দাভেদে দিনক্ষণ সামান্য পরিবর্তন হয়। মূলত বর্ষাকালটাই বন্যজন্তুদের মেটিং সিজন। খোঁজখবর নিয়ে চলে গেলাম সম্পূর্ণ অন্য দিকে। কাভাত বলে একটা জায়গায়। গড়ুরেশ্বর থেকে কাভাত গেলাম কিন্তু গাড়িতে। তা ছাড়া উপায় নেই। গন্তব্য মোটামুটি ঠিক করেছি হাফেশ্বর। কাভাত থেকে হাঁটা শুরু করলাম হাফেশ্বরের উদ্দেশে। প্রায় ২০ কিলোমিটার। অন্যদিনের থেকে একটু কম হলেও সকালে খানিকটা রাস্তা গাড়িতে আসতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে। হাঁটা শুরু করতেই অন্য অভিজ্ঞতা। এতদিন হেঁটেছি সমতলভূমিতে, এবার শুরু হল পাহাড়। হিমালয় আমি চষে ফেলেছি এতবছর ধরে। এবার শুরু হল বিন্ধ্য পর্বতমালা। আমার প্রথম দেখা। অসাধারণ। সবুজ আর সবুজ। সবুজের এত প্রাচুর্য হিমালয়ে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা গেলেও সামগ্রিকভাবে নেই। তার মধ্যে বর্ষাকাল হওয়ায় হরিয়ালি আরও বেড়েছে। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম হাফেশ্বরের ৮ কিলোমিটার আগে কড়িপানি। সারাদিন কিছুই খাওয়া জোটেনি। কড়িপানিতে একটা সিঙ্গাড়ার দোকান পেয়ে প্রাণভরে সিঙ্গাড়া খেয়ে বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাফেশ্বর।

publive-image হাফশ্বরে নর্মদা তট (ফোটো-লেখক)

হাফেশ্বরের ইতিহাস একটু আলাদা। ‘হাফেশ্বর’ - গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র, তিনটি রাজ্যের বর্ডার। একসময় বিখ্যাত এবং প্রাচীন একটি মন্দির ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটি সর্দার সরোবরের তলায়। ভগবান ডুবে গেছেন। অথচ জায়গাটা একসময় জমজমাট ছিল, ভ্রমণপিপাসুরা ভিড় জমাতেন।

publive-image হাফেশ্বর গ্রাম (ফোটো- লেখক)

একটা মন্দির জলের তলায় চলে গেল বলে জায়গাটা আজ ব্রাত্য। যদিও সরকার থেকে নতুন একটা মন্দির তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর কেউ আসে না এখানে, তায় আবার বর্ষাকাল। দীর্ঘদিন পর আমি, বাইরের কেউ একটা এল। তাও অনেক ঝক্কিঝামেলা করে। আমি এসেছি বলে নতুন মন্দিরের পুরোহিত বাচ্চাদের মত খুশী হয়েছেন। জড়িয়ে ধরলেন। গ্রামের লোকেদের মধ্যে একটা সাজ সাজ রব এসেছে। অনেকদিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলে যেমন হয়। অনেকেই দেখতে এলেন আমায়। আমি ক্যাবলার মত হাসি একে রাখলাম ঠোঁটে। থাকার ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছু নেই। একটা বিরাট বড় হলঘরে আমি একা। ভূতবাংলো মার্কা একটা ব্যাপার আছে। থেকে গেলাম অতিরিক্ত একটা দিন।

publive-image বর্ষাস্নিগ্ধ হাফেশ্বর (ফোটো- লেখক)

পরবর্তী গন্তব্য দাভানি। কিন্তু এইবার হেঁটে যাওয়া আরও মুশকিল হয়ে গেল। গভীর জঙ্গল। সবাই অনুরোধ করলেন পরবর্তী শূলপাণেশ্বর জঙ্গলটুকু গাড়ীতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তো হেঁটে যাবই। নর্মদাতট ধরে হাঁটতে পারলাম না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোনোমতে পৌঁছালাম দাভানি।

publive-image রাতের থাকার হলটায় ভূতবাংলো মার্কা একটা ব্যাপার আছে (ফোটো- লেখক)

এইবার আর রাতে থাকার জন্য কোনো মন্দির বা আশ্রম পেলাম না। গ্রামপ্রধানকে অনুরোধ করায় উনি থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন ওনার বাড়িতেই। ওনার নাম প্রেমনারায়ণ। নিজের পরিবারের খাবার থেকেই আমার খাওয়ার ব্যবস্থা। এই আতিথেয়তা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। পরদিন পৌছালাম কষ্টা। সেও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। নর্মদা কিনারে চলার কোনো উপায় নেই। থাকলাম এক ভাঙা শিবমন্দিরে। সারারাত মশার সঙ্গে সহবাস। কিন্তু এরপর আর চলার কোনো উপায় নেই। জঙ্গলের রাস্তাও বন্ধ। বৃষ্টিতে ভেঙে গেছে রাস্তা। খানিক বিফলমনোরথ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গল থেকে। অনেক দূরের রাস্তা দিয়ে গাড়িতেই পেরোলাম বাকি শূলপাণেশ্বর জঙ্গল। জঙ্গলের যেখানে শেষ সেখানে রয়েছে কোটেশ্বর। কোটেশ্বরের কাছাকাছি নেমে পড়লাম বাস থেকে।

আরও পড়ুন, পায়ে হেঁটে, ইচ্ছেমত নর্মদা (পঞ্চম চরণ)

শূলপাণেশ্বরের জঙ্গলে মূলত ভিল উপজাতির মানুষেরা থাকতেন। যখন সর্দার সরোবর ড্যাম তৈরি হয় তখন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কিছু কিছু পরিবারকে সামান্য ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁদের পূর্বপুরুষের জঙ্গল। তারা নতুন করে বাসা বাঁধেন কাছাকাছি বড় শহরগুলোতে। ভারুচ, সুরাত, ইন্দোরে। সরকারের দেওয়া টাকা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় কারণ টাকার ব্যবহার তারা জানতেন না। তাঁরা বর্তমানে রিকশা চালান বা বিভিন্ন কারখানায় মজুরের কাজ করেন। আর যাঁরা জঙ্গলে রয়ে গেলেন তাঁদের অবস্থা আরোই খারাপ। ড্যামের কারণে সেখানে কোনো সুযোগ সুবিধা পৌঁছায় না। মাত্র কুড়ি বছর আগেও অনেকে কাপড়ের ব্যবহার জানতেন না। বর্তমান প্রজন্ম খানিকটা তথাকথিত সভ্যসমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সেই কলকাতা থেকেই অনেকে সাবধান করেছেন ওদের থেকে সাবধানে থাকতে। ওঁরা নাকি মোবাইল, জিনিসপত্র এমনকি জামাকাপড় পর্যন্ত খুলে নেন। কিন্তু আমি যেটা বুঝেছি যাদের কিছুই নেই এমনকি জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় যে জঙ্গল. তাও যদি সরকার কেড়ে নেয় তাহলে কী করবেন ওঁরা?

পৌঁছে গেলাম কোটেশ্বর। একদম নর্মদা তীরে ঘাট, পাশাপাশি দুটি আশ্রম। কমলদাস বাবা আশ্রম এবং দুগড়ু বাবা আশ্রম। কমলদাস বাবা আশ্রমটি একটু বড়। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমি ছোট আশ্রমে থাকতে বেশী পছন্দ করি। দুগড়ুবাবার আশ্রমেই থাকব ঠিক করলাম। বেশ মজার আশ্রম। কিন্তু ধর্মীয় প্রকোপ ভালোই।

travelogue
Advertisment