ইলিশ কি চিনে নেবে ফেলে আসা পথ?

ফারাক্কার ন্যাভিগেশন লক পরিবর্তন করে ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি লক বসানো হবে, যাতে ইলিশের যাতায়াতের সুবিধের জন্য থাকবে বিশেষ পথ, বা 'পাস'।

ফারাক্কার ন্যাভিগেশন লক পরিবর্তন করে ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি লক বসানো হবে, যাতে ইলিশের যাতায়াতের সুবিধের জন্য থাকবে বিশেষ পথ, বা 'পাস'।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

পদ্মার ইলিশ ভালো না গঙ্গার? অতি পুরোনো এই কাসুন্দি ঘেঁটে তোলার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে সম্প্রতি। এই উপমহাদেশে খাদ্য সংক্রান্ত যত বিতর্ক আছে, পদ্মা এবং গঙ্গার ইলিশের আপেক্ষিক উতকর্ষ নিয়ে ঘোরতর বাদানুবাদ তার মধ্যে অন্যতম। দুপক্ষেরই যুক্তির সারবত্তা যথেষ্ট। ওপারের ভক্তরা তুলে ধরবেন পদ্মার মাছের অনবদ্য মাংসল গঠনের কথা, এপারের দাবিদাররা বলবেন, নোনতা-মিষ্টি স্বাদ গন্ধের নিরিখে গঙ্গার ইলিশের তুলনাই হয় না।

Advertisment

ভোজন রসিকদের দুনিয়ায় আরও অনেক বিতর্কের মতোই ইলিশ নিয়ে বাদানুবাদও কিংবদন্তি এবং উপকথা, পরিবেশ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনায়াস মেলবন্ধনের সাক্ষী। কিছু ঘটনার অবশ্য প্রামাণ্য সূত্র রয়েছে। যেমন ইলিশের বার্ষিক পরিভ্রমণ।

ইলিশের যাত্রাপথ

Advertisment

বৈজ্ঞানিক মতে, ইলিশ একটি anadromous প্রজাতির মাছ। অর্থাৎ এরা প্রধানত সামুদ্রিক, কিন্তু ডিম পাড়ে মিষ্টি জলে। বর্ষাকালে যখন ডিম পাড়ার সময় আসে, ইলিশের দল পাড়ি জমায় মোহনার দিকে, যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশছে ভারত বাংলাদেশের সমস্ত নদী। দলের একটি বড়ো অংশ চলে গঙ্গা এবং পদ্মার উজান বেয়ে। কিছু মাছ গোদাবরীর দিকে চলে যায়, এমনকি কাবেরী নদী পর্যন্ত পৌঁছানোর উদাহরণও রয়েছে। খাদ্যরসিকরা বলেন, যে মাছ যত বেশি উজান ঠেলে যাবে, তার মধ্যে তত বেশি সমুদ্র এবং নদীর স্বাদ গন্ধের মেলবন্ধন ঘটবে।

পুরোনো নথি ঘাঁটলে দেখা যায়, সত্তরের দশকেও গঙ্গার উজানে এলাহাবাদ পর্যন্ত চলে যেত ইলিশ - এমনকি আগ্রা পর্যন্তও। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকেই ইলিশের পশ্চিমগামী যাত্রায় বাধা পড়ে। বাঁধের ন্যাভিগেশন লক ফারাক্কা পেরিয়ে যেতে দেয় না মাছেদের। বিহার-উত্তর প্রদেশ সীমান্তে বক্সারে শেষবার ইলিশ ধরা হয় আজ থেকে ৩২ বছর আগে।

Hilsa fish গঙ্গার না পদ্মার?

বিষয় 'ফিশওয়ে'

এমাসের গোড়ার দিকে অতীতের প্রসব ভূমিতে ইলিশের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে একটি উদ্যোগ ঘোষণা করে সরকার। ফারাক্কার ন্যাভিগেশন লক পরিবর্তন করে ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি লক বসানো হবে, যাতে ইলিশের যাতায়াতের সুবিধের জন্য থাকবে বিশেষ পথ, বা 'পাস'।

এই ধরনের পথকে 'ফিশ ল্যাডার (মই)' বা 'ফিশওয়ে'-ও বলা হয়ে থাকে। এদের প্রধান কাজ হলো মাছেদের বাঁধ জাতীয় অবরোধ পেরোতে সাহায্য করা। সাধারণভাবে এগুলিতে ছোট ছোট সিঁড়ি থাকে, যা বেয়ে মাছেরা বাঁধের ওপারের খোলা জলে পৌঁছাতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন মইয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের নিয়ন্ত্রণ - মাছের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু এতটাও খরস্রোতা নয় যে সাঁতার কাটতে অসুবিধে হয়।

প্রথম যুগের অপরিণত 'মাছ মই' সম্ভবত তৈরি হয় পশ্চিম ইউরোপে, গাছের ডালের গোছা বেঁধে। ১৮৩৭ সালে রিচার্ড ম্যাকফার্লান নামে ক্যানাডার এক কাঠের কারখানার মালিক  তাঁর জলচালিত কাঠের কলে একটি বাঁধ যাতে মাছেরা পেরোতে পারে, সেই কারণে তৈরি একটি বিশেষ মাছ মইয়ের পেটেন্ট নেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে 'ফিশ পাস' ব্যাপারটা তামাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডায় ছড়িয়ে পড়ে।

মোটামুটি একই সময়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের তৎকালীন অগ্রণী মৎস্যবিজ্ঞানী ফ্রানসিস ডে মাছ মই নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, মূলত কাবেরীর শাখানদী কোল্লিদমের ছোটখাটো বাঁধের মধ্যে দিয়ে মাছেদের অনায়াস আনাগোনার স্বার্থে। প্রায় ৪০ বছর ধরে চালানোর পর বাতিল করা হয় সেই পরীক্ষা। উত্তর ভারতেও একইরকমভাবে ব্যর্থ হয় ফিশ পাস।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে ফিশওয়ের কার্যকারিতা নিয়ে আমেরিকায় বেশ ভালরকম বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯৪০ সালের মে মাসে 'দ্য স্ট্যানফোর্ড ইক্থিওলজিক্যাল বুলেটিন' বিষয়টিকে পরিপ্রেক্ষিতে বসায়: "ফিশ পাস তৈরির প্রক্রিয়াটি অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ, কারণ মাছের আচরণ গণনা করা প্রায় অসম্ভব, এবং জলের গতিবিধি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব। জলের শক্তি ব্যবহার করার বিষয়ে এক্ষেত্রে পারদর্শিতার প্রয়োজন, অথচ এ বিষয়ে পারদর্শি ইঞ্জিনিয়ার, যাঁরা আবার মাছের আচার আচরণ সম্বন্ধেও অবগত, খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এদিকে জলশক্তি ব্যবহারের নিয়মাবলী এবং ধ্যানধারণা ফিশ পাসের পরিচালনার ক্ষেত্রে অচল। অতএব বিষয়টি নিষ্পত্তির ধারেকাছেও নয়।"

উপরোক্ত প্রতিবেদনের পর ৭৫ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। কিন্তু সমস্যা অব্যাহত। মার্কিন পরিবেশবিদ জে জেড ব্রাউনের অধীনে ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, "আধুনিকতম ফিশ পাসের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। কিছু পরিযায়ী প্রজাতি, যেমন স্টার্জন, পাসের মধ্যে ঢোকেই না। যেসব প্রজাতি ঢোকে, সেগুলির সংখ্যাও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম"। ব্রাউনের গবেষণায় আরও দেখা যায়, আমেরিকান শ্যাড প্রজাতির মাছ, যার আকার আয়তন অনেকটাই ইলিশের সঙ্গে মেলে, স্রেফ দুই শতাংশ হারে মেরিম্যাক, কনেটিকাট এবং সাসকিউহানা নদীর বাঁধের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করেছে।

গঙ্গাবক্ষে নতুন ফিশ পাসের প্রস্থ মাত্র আট মিটার, যা কিনা ফারাক্কায় গঙ্গার প্রস্থের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। খুবই সামান্য সংখ্যক ইলিশ যদি বা গলে বেরোতে পারে, নতুন ফিশওয়ে দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উজান বেয়ে তাদের প্রাক্তন প্রসব ভূমিতে ফিরে যাবে, এমন আশা না করাই ভালো।