/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/08/Nizams-Roll.jpeg)
কলকাতার রোলের সেকাল ও একাল। গ্রাফিক্স- কাঞ্চন ঘোষ
“এ কী হল কেন হল কবে হল জানি না…”- মনে পড়ে তনুজা আর উত্তম কুমার অভিনিত ‘রাজকুমারী’ ছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠে গাওয়া এই গানটা? কলকাতার অন্যতম প্রিয় খাবার ‘রোল’-এর ব্যাপারে কথা বলতে গেলে এই গানের এই কয়েকটা লাইন মনে পড়ে বৈকি। কেন না, সেকালে তা বাঙালির হাতে উঠে এসেছিল ‘কাঠি রোল’ বা আমরা সাধারণভাবে ‘রোল’ বলতে যা বুঝি সেই রূপে। আর একালে তা দেখা দিয়েছে ‘গন্ধরাজ রোল’ হয়ে। আবার এই একই কায়দায় প্রস্তুত ‘র্যাপ’ও মার্কেটে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। রোলের এই রূপ পরিবর্তন নিয়ে নানা মানুষের নানা মত আর তাঁদের ভিন্ন পছন্দ থাকতেই পারে, কিন্তু একথা ঠিক, রোল যে রূপেই কলকাতাবাসীর খিদে মেটাক না কেন সে তার জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমতে দেয়নি।
রোলের প্রচলন হয় কলকাতাতেই। বিভিন্ন লেখক, ঐতিহাসিকের বিভিন্ন যুক্তি বিভিন্ন মতামতের পরেও এই কথাটি সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু তা কী করে হল? এই ব্যাপারে মোটামুটিভাবে একটা ইতিহাসকে তুলে আনাই যায়। বিশ শতকের শুরুর দিকে শেখ হাসান রাজা তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে ভাগ্য অন্বেষণ করতে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে তিনি তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশনে একটা কাজও জোগাড় করে ফেলেন। কাজ থেকে অবসর নেওয়ার নেওয়ার আগে তিনি ভাবলেন কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে হগ মার্কেটে (আজকের নিউ মার্কেট) পরোটা আর কাবাবের একটা দোকান দেবেন। ১৯৩২ সালে যখন কর্পোরেশন থেকে দোকান দেওয়ার জন্য প্লট নিলাম করা হচ্ছিল তখন শেখ হাসান রাজা তাঁর ছেলে শেখ নিজামুদ্দিনের নামে একটা প্লট কেনেন। এই পরোটা আর কাবাবের ছোট দোকানই আজকের কলকাতার নিজাম’স।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/08/ছবি-১-3.jpg)
কলকাতায় রোলের উৎপত্তি হয়েছিল এখানেই। এই উৎপত্তি নিয়েও আবার অনেক লোককথা প্রচলিত আছে। যেমন, কেউ বলেন বড়কর্তা সাহেবকে খাবার ভেট দিত তাঁর অনেক অধস্তন কর্মচারীরা। এমনই একদিন কোনও এক সাহেবের ইচ্ছে হয় যে সে তাঁর বসকে হাসানের এই কাবাব খাওয়াবে। সে কাবাব নিয়ে বড়কর্তা সাহেবের কাছে যখন যায় তখন কর্তা সেই কাবাবের তেল হাতে লেগে যাওয়ার বিরক্তিতে কাবাব খেতে চান না। এই অবস্থায় সে সেই কাবাবগুলো ফিরিয়ে নিয়ে এসে এসব কথা হাসানকে বলে। সেই সাহেব কর্মচারী বলে যে এমন কোনও একটা উপায় বার করতে হবে যাতে বড়কর্তা কাবাবও খেতে পারেন এবং তার হাতে তেলও না লাগে। হাসান এই সমস্যার সমাধান করতে তাঁর স্ত্রীয়ের কাছে যায়। তাঁর স্ত্রী বুদ্ধি করে একটা পরোটা সেঁকে তার মধ্যে কাবাবগুলোকে পুরে পুরোটাকে একটা কাগজে মুড়ে হাসানের হাতে দেয়। -অনেকের মতে এইভাবে কলকাতায় রোলের জন্ম হয়।
আরও পড়ুন কলকাতায় বিরিয়ানি আর আলুর অমর প্রেমকাহিনী
আবার, একটা জনশ্রুতি এমনও আছে যে, হাসানের কাছে একজন অশ্বারোহী ইংরেজ সাহেব এসেছিল কাবাব খাবে বলে। সেই সাহেব খুবই তাড়ায় ছিল। সাহেবের এই তাড়া দেখে হাসান তাকে কাবাবগুলো একটা পরোটায় মুড়ে হাতে দিয়ে দেয়। সেই দেখাদেখি অন্যান্য সাহেবরাও এই একই পদ্ধতিতে হাসানের কাছ থেকে এই ‘রোল’ অর্ডার করতে থাকে। জন্ম নেয় কলকাতার ‘রোল’।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/08/ছবি-২-4.jpg)
এ বিষয়ে লেখক মোহনা কাঞ্জিলালের মতামত একটু আলাদা। তাঁর কথায়, বিশ শতকের শুরুর দিকে ওই একই সময়ে শেখ হাসান রাজার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা খলিফা নামের আরেক রাঁধুনির পরিচয় হয় এবং তাঁরা দুজনে একসঙ্গে হগ মার্কেটে পরোটা আর কাবাব বানাতে শুরু করেন। তাঁদের খাবার সাহেব আর মেমদের এত ভাল লাগে যে তাঁরা অনুরোধ করেন যাতে কাবাবগুলো তাঁরা আলাদাভাবে না বিক্রি করে পরোটার মধ্যে পুরে বিক্রি করে। যাতে করে সেই কাবাব খেতে গিয়ে তাঁদের হাতে তেল না লাগে। এই আইডিয়ার পর থেকেই রোলের উৎপত্তি হয়। তবে, লোককথা বা জনশ্রুতি যাই থাকুক না কেন। একথা সত্যি যে পরোটায় মোড়া মাংসের কাবাবের এই পদটি তার জন্মলগ্ন থেকেই খুব জনপ্রিয় ছিল।
শেখ হাসান রাজার পরে তাঁর ছেলে নিজামুদ্দিন পিতার ব্যবসা সামলান এবং বিফের পাশাপাশি মটন কাবাব এবং মটন রোল বানাতে শুরু করেন। ভারতের স্বাধীনতার পর, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে নিজাম’সে শুরু হয় চিকেন ‘কাঠি কাবাব’। কাবাবের শিকের জায়গায় মোটা কাঠি ব্যবহার করে চিকেনের কাবাব বানানো শুরু হয়ে ওই বছর। এবং তারপর সেই চিকেনই পরোটায় ভরে তৈরি হয় ‘কাঠি রোল’। তারপর যত দিন গেছে ততই উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রকারের রোল, আলু রোল, পনির রোল, এগ আলু রোল ইত্যাদি।
এবার একটু ফিরে আসা যাক একালের দিকে। বহুকাল আগে বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাস লিখেছিলেন “দেইখ্যা আইলাম তারে সই দেইখ্যা আইলাম তারে।/ এক অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে।।” ঠিক এমনই এক অবস্থা হয়েছে আজকের ফুড ব্লগারদের মধ্যে। এর কারণ সেই ‘রোল’। ‘গন্ধরাজ রোল’। দক্ষিণ কলকাতার বিজয়গড়ের এক ফাস্ট ফুড সেন্টারে এই প্রকারের রোল বানানো শুরু হয়েছে বিগত কয়েকদিন ধরে। অন্যান্য রোলের মতোই এই রোলও একইভাবে প্রস্তুত করা হয় শুধু পরোটার রঙ সবুজ। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন, গন্ধরাজ লেবুর খোসার রঙের মতো সবুজ। রোলের এই রঙ দেখে কলকাতাবাসী পাগল হয়ে পড়েছে। ইদানিং খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল ‘গন্ধরাজ মোমো’। সেই সূত্র ধরেই বাজারে এসেছে এই ‘গন্ধরাজ রোল’। উপকরণ ও স্বাদ নিয়ে নানা মানুষের নানা মত থাকলেও বর্তমানে সবারই মন আনচান করছে একবার এই রোলকেও চেখে দেখার।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/08/ছবি-৩-4.jpg)
এছাড়াও আছে, রুমালি রোল আর র্যাপ। দক্ষিণ কলকাতার বাসন্তি দেবী কলেজের কাছে এক পুরনো খাবার হোটেলে এমনি রোলের পাশাপাশি পাওয়া যায় রুমালি রুটির রোল। এর প্রস্তুতিও একইরকম শুধু তেলেভাজা পরোটার জায়গায় এখানে ব্যবহার করা হয় একটা গোটা রুমালি রুটি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/08/ছবি-৪-3.jpg)
এর মতোই এখন হোটেল রেস্তরাঁর পাশাপাশি কলকাতার বিভিন্ন ক্যাফেতে পাওয়া যায় নানা ধরনের ‘র্যাপ’। ভেজ র্যাপ, চিকেন র্যাপ ইত্যাদি। বর্তমানে কলকাতার রোলের চাহিদাকে টক্কর দিচ্ছে এই খাবারটাও। এর প্রস্তুতি রুমালি রোলের মতোই শুধু এখানে মেয়োনিজ্, চিজ্ ইত্যাদি উপকরণ যোগ করা হয়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/08/ছবি-৫-2.jpg)
সবশেষে ফিরে যেতে হয় একদম শুরুতে, “এ কী হল কেন হল কবে হল জানি না…”। কলকাতাবাসীর এত জনপ্রিয় একটা খাবারের এক অঙ্গে এত রূপ কীভাবে ফুটে উঠল আর কবেই বা ফুটে উঠল এর হিসাব কেউ রাখেনি। কারণ, সেকালে হোক বা একালে, যেকোনও রূপেই রোলের স্বাদ কলকাতাবাসীকে মজিয়ে রেখেছে।
সূত্র: Kanjilal, Mohona, ‘A Taste of Time: A Food History of Calcutta’