পানিপুরি, গোলগাপ্পা, গুপচুপ, একেক শহরে একেক নাম। স্বাদও হরেকরকম। বাংলায় যার নাম ফুচকা। বাঙালির কাছে ফুচকা একটা আবেগ, একটা ফেনোমেনা। মফঃস্বলের গলির মোড়ে মোড়ে ফুচকাওলাদের ঘিরে লেগে থাকে আলাদা আলাদা গল্প। কলকাতা শহরেও তাই, তবে কি না শহরে ভিড় খানিক বেশি বলে গল্প তৈরিও হয় ঘন ঘন, আবার তারা বিস্মৃতির আড়ালেও চলে যায় বড় তাড়াতাড়ি। ৪৫ বছর ধরে এই শহরের বুকে ফুচকা তৈরি করা এক সহনাগরিকের গল্প বলব আজ।
সাদার্ন অ্যাভেনিউ-এর বিবেকানন্দ পার্কের দিলীপ দার দোকান। মহারাজা চাট সেন্টার। চার দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ কলকাতার বিকেলগুলোর রঙ পালটে দিচ্ছেন মানুষটা। কত 'গলাগলির দিন, দলাদলির দিন'-এর সাক্ষী থেকেছেন মানুষটা। দিলীপ সাউ। জন্মসূত্রে বিহারের মানুষ। চার দশক আগে উদবাস্তু হয়ে এ শহরে আসা বাবার হাত ধরে। তারপর নিজেকে মিশিয়ে দিলেন কলকাতার স্রোতে।
আরও পড়ুন, ফোন নম্বরগুলো মনে থাকে না আর, মিসড কলও আসে না
দিলীপ দার দোকানে গেলেই হাত ধুতে হবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে। ঠেলার একপাশে রাখা অ্যাকোয়া গার্ড। সেখান থেকে ফিল্টার হওয়ার পর বোতলে বোতলে ভরে রাখা জল। সেই জল দিয়ে তেঁতুল মিশিয়ে তৈরি হয় ফুচকার টক জল। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই দিলীপ দা চলে আসেন বিবেকানন্দ পার্কের পাশের গলিতে। কোনওদিন সঙ্গে আসে ছেলে, কোনওদিন মেয়ে, বউ। হাতে হাতে কাজ এগিয়ে রাখেন পরিবারের সবাই। কালে কালে সেলিব্রিটি স্টেটাস পেয়েছেন দিলীপ দা।
আরও পড়ুন, ফোম দেওয়া পুডিং! ৮২ বছর ধরে কথা রাখছে এই সাবেকি ক্যাফে
শহরে প্রথম আমিষ ফুচকা চালু করেছিলেন এই মানুষটাই। চিকেন, মাটন, প্রন ফুচকা অর্ডার দিতে চাইলে দিন দুয়েক আগে থেকে বলে রাখতে হয় শুধু। রোগীর পথ্য হিসেবে ফুচকা চেখে দেখেছেন কখনও? ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য আলুর বদলে কাচকলার পুর দিয়েও ফুচকা মেখে দেন। তাছাড়া দইফুচকা, ডাব ফুচকা, চকোলেট ফুচকা, ভুট্টার ফুচকা, টক-মিষ্টি ফুচকা সবই পাবেন তাঁর দোকানে। কলকাতা শহরে তো বটেই, এমনকী ফুচকা নিয়ে হিল্লি দিল্লি করে বেড়ান দিলীপ সাউ। মিত্তল পরিবারের বিয়েতে চেন্নাই-এর তাজ হোটেলেও কাটিয়ে এসেছেন বেশ ক'দিন।
বিকেল হলেই পায়ে পায়ে লোক জমতে থাকে মহারাজা চাট সেন্টারে। কেউ আসছেন পুরনো বন্ধুকে নিয়ে শৈশবের আমেজ নিতে, কেউ আবার বিদেশ থেকে কলকাতায় নেমেই এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে আসছেন সাদার্ন অ্যাভেনিউ। নিয়মিত আসা যাওয়া থাকলে দিলীপ দা ঠিক মনে রেখে দেন, কার ফুচকায় ঝাল বেশি হবে, কার পুর ধনেপাতা ছাড়া, কিঞ্চিৎ কুশল বিনিময় হয়, কে কবে কলকাতা ছাড়ছে, খবর নিয়ে নেন মানুষটা। এই বিশাল শহরে এত খুঁটিনাটি খবর কতজন রাখে? এ-সব ভাবতে ভাবতে আলো-আঁধারি রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। জীবনের কাছে একটা আস্ত 'ফাউ' পাওয়া হয়ে যায় এমন বিকেলে।