Advertisment

জীর্ণ বিস্মৃতির জার্নালে ইতিহাসের অবহেলিত ধ্বংসস্তূপ বাংলার এই অখ্যাত গ্রাম

কালের গর্ভে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তবে একবার ঘুরে আসতে পারেন

author-image
Subhamay Mandal
New Update
Offbeat Tour: This village in Hooghly holds the history of Sepoy Mutiny

বিস্মৃতির অতলে সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার বালি দেওয়ানগঞ্জ। গ্রাফিক্স-প্রত্যুষ রায়

রাঢ় বাংলা বরাবরই ইতিহাস সমৃদ্ধ। সেই কর্ণসুবর্ণের ইতিহাস থেকে শুরু করে, পাল, সেন, নবাব ও ব্রিটিশদের মূল কর্মভূমি ছিল রাঢ়বঙ্গ। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের টান ছিল অমোঘ। বহু মানুষ, নানা জাতি ও বর্ণের এই বঙ্গে এসে এমন ভাবে মিশে গিয়েছেন যে তাঁরা চলে গেলেও তাঁদের ছাপ ছেড়ে গিয়েছেন এই বাংলার মাটিতে। তেমন অনেক ইতিহাসই এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় অস্তিত্বের সংগ্রাম চালিয়ে কোনওক্রমে টিকে থাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে চলেছে।

Advertisment
offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
শিবকুটিরের মূল ফলকের উপর পঙ্খের কারুকাজ

তেমনিই একটি অঞ্চল হল হুগলি জেলার আরামবাগের কাছে অবস্থিত দুটি গ্রাম। বালি ও দেওয়ানগঞ্জ। একত্রে এই দুই গ্রামকে বলা হয় বালিদেওয়ানগঞ্জ। মূলত ভীষণভাবেই অখ্যাত এই গ্রামের বহু জায়গায় এখনও পৌছয়নি স্ট্রিট লাইট। কিন্তু এই অঞ্চলে স্থাপত্য ও পুরাকীর্তির কিছু এমন নিদর্শন রয়ে গিয়েছে যে এটি সেই সময়কার সমৃদ্ধির এক চিত্র ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু কতদিন? ইতিহাসপ্রেমীদের মনে এই আশঙ্কার কালো মেঘেরও সঞ্চার করে দেয় বালি দেওয়ানগঞ্জে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ও ধ্বংসের দিন গুনতে থাকা এই অঞ্চলের স্থাপত্য কীর্তিগুলি।

offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
ভগ্নপ্রায় শিব কুটির

বালি দেওয়ানগঞ্জে ঢুকতেই প্রথম যে দৈত্যকায় বাড়িটি চোখে পড়বে সেটির নাম শিব কুটির বা শিবকুঠি। প্রকাণ্ড বাড়িটির স্থাপত্যকীর্তি দেখলে অবাক হতে হয়। প্রায় ভগ্নদশায় পড়ে থাকা এই বাড়িটির যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেইটুকু বিস্মিত করতে পারে। এই বাড়িটিতে ঢোকার মূল ফটকের উপর পঙ্খের কাজ করা। বাড়িটি বর্গক্ষেত্রাকার। মাঝে একটি প্রকাণ্ড দালান। বাড়িটির সামনের দিকের দুই কোণে দুটি মিনার। মূলত জমিদারির রক্ষণাবেক্ষণ ও দূর অবধি দেখতে পাওয়ার সুবিধার জন্য এই মিনার দুটি নির্মিত। উচ্চতা প্রায় চার তলা বাড়ির সমান। একটি মিনারের মেঝে বহু আগে ধ্বসে গিয়েছে। একটির এখনও টিকে থাকলেও সেটিকে 'অক্ষত' বলা যায় না। কোথাও ভেঙে গিয়েছে খিলান, কোথাও সিঁড়ি ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে আছে।

offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
শিবকুটিরের সুড়ঙ্গপথ, অভূতপূর্ব বাস্তুশিল্পের নিদর্শন

কথিত আছে, শিব নামক এক জমিদার এই বাড়িটি তৈরি করান তাঁর নীল চাষের এস্টেট দেখাশোনা করতে। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে নীল চাষিরা দিকে দিকে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তিনি এই বাড়িটি পরিত্যক্ত রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এই বাড়িটির মূল আকর্ষণ হল এর দুটি সুড়ঙ্গ যা এক সময় বাড়িটিকে দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাটের সঙ্গে চোরাপথে যুক্ত করত। স্থানীয় প্রচার অনুসারে, জমিদার এই পথ ব্যবহার করে পালিয়ে যান। সেই সুরঙ্গের মুখটি এখনও খোলা থাকলে ভিতরে যাওয়ার জো নেই। কিছু জায়গায় মাটি ধসে বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে, তাছাড়া রয়েছে সাপখোপের ভয়ও।

offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
জরাজীর্ণ লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির

এই বাড়িটির লাগোয়া একটি মন্দির যা রত্ন শৈলীতে নির্মিত, সেটিও ভেঙে পড়ে রয়েছে। মন্দিরটির নাম, লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির। লতা পাতা ও অশ্বত্থ গাছ মন্দিরটিকে পরজীবীর মতন আঁকড়ে ধরে গজিয়ে শুষে নিয়েছে তাঁর প্রাণশক্তি। মন্দিরটি ভগ্ন দশায় পড়ে রইলেও মন্দিরগাত্রে পোড়া মাটির কারুকার্য মুগ্ধ করবেই।

offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
রাউতপাড়ার অক্ষত দুর্গামন্দির

শিবকুটির থেকে কিছুটা এগিয়েই রাউতপাড়া। এখানে রয়েছে পাঁচটি মন্দির। যার মধ্যে তিনটির অবস্থা শোচনীয়। ইংরেজ ইতিহাসবিদ ডেভিড ম্যাককাচ্চন (David McCutcheon) সর্বপ্রথম এই মন্দিরগুলির কথা লিপিবদ্ধ করেন তাঁর গবেষণাভিত্তিক জার্নালে। ত্রয়োদশরত্ন, অর্থাৎ তেরটি চূড়া সম্বলিত চণ্ডী মন্দিরটি কালের নিয়মে ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাকি দুটি মন্দিরের অবস্থাও তথৈবচ। তবু কিছুটা বহাল তবিয়তেই বেঁচে রয়েছে এই অঞ্চলের দুর্গা মন্দিরটি। দোচালা গর্ভগৃহের উপর রত্ন সম্বলিত এই মন্দিরটি বাংলার মধ্যযুগের উন্নত স্থাপত্যশৈলীর এক অভূতপূর্ব নিদর্শন। মন্দিরে ঢোকার মুখেই টেরাকোটা ফলকে সুচারু কারুকাজে অধিষ্ঠান করছে দুর্গা, দুই পাশে লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী ও কার্তিক সহ। একমাত্র এই মন্দিরটিতে রক্ষণাবেক্ষণের ছাপ স্পষ্ট। এই মন্দিরটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব ও হেরিটেজ বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত।

offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
রাউতপাড়ার ভগ্ন রত্ন মন্দির

এই অঞ্চল থেকে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে দামোদর মন্দির। এই মন্দিরটি অক্ষত অবস্থায় থাকার দরুন ভাস্কর্য শিল্পের এক নিদর্শন রূপে ধরা দেয়। মূলত রাধা-কৃষ্ণকে উৎসর্গীকৃত এই মন্দিরের পরতে পরতে টেরাকোটার শিল্পে বর্ণিত রয়েছে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার, কংসবধ ও রামায়ণের বিভিন্ন কাহিনী।

আরও পড়ুন প্রেমদিবসে হাড়হিম অভিজ্ঞতা! কলকাতার কাছেই একটি রাত কাটিয়ে আসুন ‘তেনাদের’ সঙ্গে

কীভাবে পৌছবেন বালি দেওয়ানগঞ্জ?

হাওড়া থেকে আরামবাগ বা গোঘাট লোকাল ধরে নেমে পড়ুন আরামবাগ স্টেশনে। সেখান থেকে বাস, অটো বা টোটোয় পৌছে যেতে পারেন বালি দেওয়ানগঞ্জ। কলকাতা থেকে আরামবাগগামী কিছু বাসে করেও সরাসরি পৌছে যেতে পারেন বালি দেওয়ানগঞ্জ।

offbeat tour, travelogue,travel blog,weekend tour,west bengal, lifestyle
দামোদর মন্দির, অক্ষত ভাস্কর্য সম্বলিত

কোথায় থাকবেন?

বালি দেওয়ানগঞ্জ একটি অখ্যাত গ্রাম। ফলেই এখানে থাকা ও খাওয়ার তেমন সুবন্দোবস্ত নেই। তবে এই জায়গাটি একদিনেই ঘুরে দেখা যায়। সকাল সকাল বেরিয়ে সন্ধ্যেয় ফিরে আসার জন্য উপযুক্ত স্থান এই বালি দেওয়ানগঞ্জ।

ইতিহাসের এই জীর্ণ নিদর্শনগুলি কালের গর্ভে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তবে একবার ঘুরে আসতে পারেন বালি দেওয়ানগঞ্জ।

travelogue West Bengal history
Advertisment