Advertisment

ফিরিয়ে দাও আমার ভবানীপুরের পাড়ার পুজো

প্যান্ডেলগুলো বিশাল, কী চমৎকার তাদের সাজসজ্জা, থিম, প্রতিমা, কিন্তু সেই আপন আপন গন্ধটা নেই। বেশ কিছু বড় পুজোয় তো দেখি প্যান্ডেলের গায়েই স্পন্সরদের লোগো, যেন মা দুর্গার ফ্লাইট টিকিটের টাকা দিয়েছে ওরা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
childhood durga puja kolkata

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

আশির দশকে ভবানীপুরের সুশীল সেন রোডে আমার বেড়ে ওঠার সময়টায় যে 'পাড়া' ব্যাপারটা ছিল, সেটার কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে। অশোকদার চা-পাউরুটির দোকানের সঙ্গে আমার অথবা আমার বাবা-মায়ের সম্পর্কটা ছিল এরকম - যদি কিছু কিনে দাম দিই তো ভালো, না দিলেও ভালো। শেষমেশ যে টাকা মার যাবে না, জানতেন। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে এক ধোপার দোকানে তার বাবার সঙ্গে থাকত একটি ছ-সাত বছরের ছেলে। ছেলেটি সারাদিন রান্না বা কাপড় ইস্ত্রি করত, আর তার বাবা চালাতেন টানা রিক্সা। খাবারে টান পড়লে ওই রাস্তার যে কোনও বাড়িতে গিয়ে চাইতেন ওঁরা, কেউ ফিরিয়ে দিত না।

Advertisment

তাঁর ভাই জ্যোতি বসুর মুখ্য সচিব, সেই সুবাদে আমাদের বাড়িওয়ালা ছিলেন পাড়ার 'দাদা'। তাঁর স্ত্রী ছিলেন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আমি তাঁদের ডাকতাম 'বাবা-মা' বলে, কারণ আমার নিজের বাবা-মা কাজে চলে গেলে তাঁরাই হতেন আমার অভিভাবক। উল্টোদিকের বাড়িতে থাকত কিছু গুজরাতি পরিবার, কিছুটা দূরে থাকত কয়েক ঘর শিখ পরিবার, বাকি সব বাঙালি। কিন্তু আমরা যে যাই হই, উৎসবে আনন্দে মিলেমিশে যেতাম, যা দুর্গাপুজোর সময় সবচেয়ে বেশি করে নজরে পড়ত।

পুজোয় কিন্তু কেউ কোনও নির্দিষ্ট চাঁদা চাইতে আসত না, আমরা পাড়ার ছেলেদের হাতে যে যা পারতাম দিতাম। অশোকদার চায়ের দোকানের পাশেই ছিল তাদের আড্ডা, এবং সারাবছর তারা তৈরি থাকত যে কোনোরকম সাহায্য করতে। সে ড্রাইভিং লাইসেন্স যোগাড় করা হোক, কী ট্যাক্স জমা দেওয়া, কোথাও পার্সেল পাঠানো, অথবা কিছুক্ষণের জন্য বাচ্চা সামলানো। চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেলে বেরিয়ে আসত ক্যারম বোর্ড, মাথার ওপরে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে খেলা চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। ফলত পাড়ার রাস্তাঘাট থাকত সম্পূর্ণ নিরাপদ। এতই পরিচিত এই ছেলের দল, যে তাদের হাতে প্যান্ডেল তৈরির কাজ সঁপে দেওয়া যেত নির্দ্বিধায়, পাড়ার বড়রা প্রয়োজনে তত্ত্বাবধান করতেন।

কাপড়ে মোড়া বাঁশ দিয়ে বাঁধা হতো প্যান্ডেল, আর প্রতিমা বসানোর জন্য তৈরি হতো নড়বড়ে কাঠের মঞ্চ, সবটাই ওই ছেলের দলের দৌলতে। নির্দেশ অবশ্য বর্ষিত হতো চারদিক থেকে, মা-ঠাকুমারা ব্যালকনি থেকে উচ্চৈঃস্বরে হুকুম জারি করতেন, আর ঠিক তার বিপরীত নির্দেশ আসত প্যান্ডেলের ভেতরে দাঁড়ানো বাবা-কাকাদের কাছ থেকে। আমরা বাচ্চারা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো প্যান্ডেল বাঁধার বাঁশ নিয়ে ছুট লাগাতাম, কারণ ওই বাঁশ দিয়ে দোতলার বারান্দাগুলোয় চড়া যেত।

আমি এবং আমার পরিবার ১৯৯০ সালে ভারত ছেড়ে ব্রিটেনে চলে যাই, এবং সেখানেই থেকেছি তার পর থেকে। কিন্তু আমি ভারতে ফিরি ২০১৩ সালে, এবং তখন থেকে প্রতিবছর যেন একটু একটু করে পুজোটা আমার সেই ভবানীপুরের দিনগুলোর থেকে এক পৃথিবী দূরে সরে গেছে। সময়, উন্নয়ন, বিকাশ, সব মাথায় রেখেই বলছি একথা।

আজকের পুজো প্রায় পুরোপুরি ব্যবসায়িক। আমি দেখতে পাই, হোর্ডিং টাঙানোর জন্য খোঁড়া হচ্ছে রাস্তা, ফুটপাথ, এত বড় হোর্ডিং যে প্যান্ডেলই দেখা যায় না। সাবান, ল্যাপটপ, ওয়াশিং মেশিনের দেওয়াল ভেদ করে দেখতে পাই না মায়ের বাপের বাড়ি ফেরা। প্যান্ডেলগুলো বিশাল, কী চমৎকার তাদের সাজসজ্জা, থিম, প্রতিমা, কিন্তু সেই আপন আপন গন্ধটা নেই। বেশ কিছু বড় পুজোয় তো দেখি প্যান্ডেলের গায়েই স্পন্সরদের লোগো, যেন মা দুর্গার ফ্লাইট টিকিটের টাকা দিয়েছে ওরা।

দেশে ফেরার পর প্রথমবার আমার 'ঠাকুর দেখতে যাওয়া' ঘটে ২০১৭ সালে। আমার পরিবারের সঙ্গে পিকনিক গার্ডেন থেকে হেঁটে বেরিয়ে রাসবিহারী কানেক্টর ধরে গড়িয়াহাট এলাকা পর্যন্ত। স্তম্ভিত হয়ে আমি শুধু দেখছিলাম বিপুল পরিমাণ হোর্ডিংয়ের সংখ্যা - রাস্তার ধারে, মাঝখানে, সর্বত্র। বাঁশ দিয়ে বেঁধে দেওয়া প্যান্ডেলে ঢোকার বা তা থেকে বেরোনোর পথের ধারে বড় বড় ব্র্যান্ডের স্টল, সেগুলির বাইরে দাঁড়িয়ে শ্যাম্পু, খাওয়ার জিনিস, লিফলেট বিলি করছেন কর্মীরা। এক-আধটা ঝালমুড়িওয়ালা বা চাউমিনের দোকান ছাড়া স্থানীয়, বা কলকাতার চিরাচরিত রাস্তার খাবারের নামগন্ধ নেই কোথাও। প্রতিটা প্যান্ডেলের সেই এক কমার্শিয়াল বাহ্যিক পরিবেশ, তফাৎ যা কিছু তা শুধু প্যান্ডেলের নিজস্ব সজ্জা, বা প্রতিমার ক্ষেত্রে।

তবে এটা বলতে হবে, রেড রোডে দুর্গাপুজোর প্যারেড দেখতে বেশ লাগে - সারা শহরের বড় পুজোগুলোর ঠাকুর একবারে দেখা হয় যায়, লাখ লাখ লোকের ভিড় ঠেলে-গুঁতিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকতে হয় না, খুব সুবিধে। আমার বিশ্বাস, কলকাতার এই যে চমৎকার একটা রাস্তা, যা যে কোনোরকম অনুষ্ঠানের পক্ষে আদর্শ, ততটা ব্যবহার করা হয় না যতটা করা উচিত, যদিও এ এমন এক রাজপথ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের রানওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পুজো প্যারেডের সবচেয়ে বড় খামতির জায়গা হলো টিকিট বিক্রি। পর্যটক হোন বা স্থানীয় বাসিন্দা, টিকিট কোথায় বিক্রি হচ্ছে তা খুঁজে পাওয়াই দায়। নবান্নর উচিত এই প্রক্রিয়া আরও সরল করে তোলা, এবং টিকিটের দাম অনুযায়ী আসন নির্দিষ্ট করা।

একদিক থেকে দেখতে গেলে দুর্গাপুজোর এই ক্রমশ বাড়তে থাকা ব্যবসায়িক আঙ্গিকের একটি ইতিবাচক দিকও আছে - বোঝা যায়, বাংলার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে, যে টাকায় ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। বাড়ছে পুজোর সংখ্যা, বিস্তৃত হচ্ছে পুজোর স্থান, লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে উন্মুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্যান্ডেল, খাওয়ার জায়গা, ঘোরার জায়গা।

সব ঠিক আছে, কিন্তু দিনের শেষে একটা কথা মনে রাখার - মা বাড়ি আসছেন। একটি পাড়ার প্যান্ডেল সেই এলাকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মানুষের ধারা বহন করে। এক সময় উত্তর কলকাতার বিভিন্ন রাজবাড়ির মাথার ওপর আকাশে আতসবাজির রোশনাই জানান দিত, পুজো এসেছে। আর আজ ফ্রিজ আর ওয়াশিং মেশিনের ওপর ছাড়ের ঘোষণা থেকে আমরা জানতে পারি, বিক্রিবাটার সময় এসেছে।

(জন্মসূত্রে আর্মেনিয়ান অ্যান্টনি খাচাতুরিয়ানের ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতায়। বর্তমানে তিনি কলকাতার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন)
Durga Puja 2019
Advertisment