জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের ত্রয়োদশী তিথি। গৌড়বঙ্গীয় ধারার বৈষ্ণবদের কাছে এই তিথি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই তিথিতেই বৈষ্ণব সেবার মহিমা, গুরু ও গুরুতত্ত্বের মহিমার শিক্ষা দিয়েছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। এই উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল, তার নাম পানিহাটি দণ্ডমহোৎসব বা পানিহাটির চিড়া-দধি মহোৎসব। এই উৎসবের শুরু হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের সময়কালে। তাঁর ঘনিষ্ঠতম পার্ষদ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর উপস্থিতিতে। এবার এই উৎসব হতে চলেছে আগামিকাল ২ জুন শুক্রবার।
Advertisment
এই পানিহাটিতে থাকতেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের বিশেষ পার্ষদ রাঘব পণ্ডিত। রাঘব পণ্ডিতের বাড়ি সম্পর্কে গৌড়বঙ্গীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলা রয়েছে- মহাপ্রভু চার জায়গায় অবস্থান করেন। একটি হল শচীর রন্ধনে, শ্রীবাস অঙ্গনে, নিত্যানন্দ নর্তনে, রাঘব ভবনে। এর মধ্যে কেবল রাঘব ভবনে মহাপ্রভুর থাকার সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। বাকি তিন জায়গার মধ্যে শচীদেবী যখন রান্না করতেন, বোঝানো হয়েছে তখন মহাপ্রভু থাকতেন। শ্রীবাসের অঙ্গনে যখন সংকীর্তন হত, তখন মহাপ্রভু থাকতেন। প্রভু নিত্যানন্দ যখন নৃত্য করতেন, তখন মহাপ্রভু থাকেন বলে বোঝানো হয়েছে।
Advertisment
এই অনুষ্ঠানের সূত্রপাতের সময়ে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু তাঁর পার্ষদদের নিয়ে পানিহাটিতে রাঘব পণ্ডিতের কাছে এসেছিলেন। বসেছিলেন, গঙ্গার তীরে এক বটবৃক্ষের তলায়। সেখানে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে দর্শন করার জন্য এসেছিলেন সপ্তগ্রামের জমিদার গোবর্ধন রায়ের একমাত্র ছেলে রঘুনাথ দাস। তিনি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দর্শন করছিলেন। এক ভক্ত নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে সেকথা জানানোর পর নিত্যানন্দ মহাপ্রভু বলেছিলেন, 'ওরে চোর, এতদিনে তুই দেখা দিলি। আয় আয়, আমি তোকে দণ্ড দেব। আমার কাছে না-এসে তুই চোরের মত দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াস। আজ তোর নাগাদ পেয়েছি। তোকে দণ্ড দেব। আমার ভক্তদেরকে এখনই চিড়া-দধি খাওয়াতে হবে।'
সেই কথা শুনে রঘুনাথ দাস অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁর লোকজনকে পাঠিয়ে চিড়া, দধি, দুধ, সন্দেশ, চিনি ও কলা আনিয়েছিলেন। সেসব পরিবেশন করার জন্য আনিয়েছিলেন ৪০০টি মালসা বা গোল হোলনা। এই উৎসবের কথা শুনে আশপাশ থেকে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, পণ্ডিতরা এসেছিলেন। তাঁদেরকেও দেওয়া হয়েছিল চিড়া-দধি। সেজন্য আরও মালসা আনা হয়। প্রত্যেককে দুটি করে মাটির মালসা দেওয়া হয়েছিল। যার একটিতে ছিল দুধ-চিড়া, অন্যটিতে দধি-চিড়া। সেই থেকে এই উৎসবের সূচনা। গৌড়বঙ্গীয় বৈষ্ণব ভক্তদের ধারণা, এই দিনটিতে আজও নিত্যানন্দ মহাপ্রভু দই-চিড়ার মেলায় উপস্থিত থাকেন। আর, তাঁর মাধ্যমে উপস্থিত থাকেন স্বয়ং মহাপ্রভু চৈতন্যদেবও। দণ্ডদানের মাধ্যমে এই উৎসব শুরু হয়েছিল বলে, এর নাম দণ্ডমহোৎসব।
পরবর্তী সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মহাত্মা গান্ধী- অনেকেই এসেছেন। প্রতিবছর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কয়েক লক্ষ ভক্তের ভিড় হয়। উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয় ২ মাস আগে থেকে। উৎসবের দিন ভোর ৪টায় মঙ্গল আরতির মধ্যে দিয়ে হয় পরবর্তী কার্যক্রমের সূচনা। এই উৎসব ভারত এবং ভারতের বাইরেও গৌড়বঙ্গীয় ভক্তরা পালন করে থাকেন।